Advertisement
E-Paper

গিটার-বেহালা হাতে পথে বেঁচে থাকার গান 

বেহালা হাতে একুশের তরুণ। পাশে গিটার নিয়ে তেইশ। তাঁদের গলায় উদাত্ত গান। ভিক্টোরিয়ার সামনে এ ভাবে দুই তরুণকে গাইতে দেখে পায়ে পায়ে থমকাচ্ছেন পথচারীদের অনেকে।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০১:১৮
সুরে সুরে: কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের পাশে চলছে গানবাজনা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

সুরে সুরে: কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের পাশে চলছে গানবাজনা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

‘যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন’।

পড়ন্ত বিকেলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সাউথ গেটের সামনেটা তখন ভাসছে সুরের মূর্ছনায়। রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু আরও একটা গান— ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’। চারপাশে তখন গোধূলির নরম আলো।

বেহালা হাতে একুশের তরুণ। পাশে গিটার নিয়ে তেইশ। তাঁদের গলায় উদাত্ত গান। ভিক্টোরিয়ার সামনে এ ভাবে দুই তরুণকে গাইতে দেখে পায়ে পায়ে থমকাচ্ছেন পথচারীদের অনেকে। কেউ আবার ব্যস্ত মোবাইলে দু’জনের ছবি তুলতে। গান শুনে চলে যাওয়ার আগে অনেকেই সামনের খোলা বাক্সে দশ-কুড়ি-পঞ্চাশের নোট রেখেও যাচ্ছেন।

কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও রবীন্দ্র সরোবর, তো কখনও পার্ক স্ট্রিট, নন্দন চত্বর বা টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন চত্বর— শহরের আনাচেকানাচে পথ চলতে গিয়ে দেখা হতেই পারে সৌরজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পথের পাশে তখন হয়তো ‘বাস্কিং’য়ে ব্যস্ত কসবা ও বেহালার বাসিন্দা ওই দুই তরুণ। বাংলা ব্যান্ড থেকে লোকসঙ্গীত, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, গত অক্টোবর থেকে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন পথের ধারে এমনই গানের ডালি নিয়ে হাজির থাকেন বাঘা যতীন সম্মিলনী কলেজের তৃতীয় বর্ষের সৌরজ্যোতি এবং বেঙ্গল মিউজ়িক কলেজের ছাত্র কৃষ্ণেন্দু।

রাস্তার পাশে যে কোনও বিনোদন দেখিয়ে বা শুনিয়ে অর্থোপার্জনের এই পদ্ধতি বিশ্বে চালু হয়েছিল সেই কবে। তবে বাস্কিং শব্দটি চালু হয় ১৮৬০ সালে, ব্রিটেনে। ঊনিশ শতকে দেশ-বিদেশে ঘুরে বাস্কিং করতেন ইতালির স্ট্রিট মিউজ়িশিয়ানরা। রোম থেকে ফ্রান্স, আমেরিকা থেকে জাপান— বিশ্বের সব দেশেই বাস্কিং রীতিমতো জনপ্রিয়। ক্যালিফোর্নিয়া বা ইউরোপে রক এবং মেটাল গেয়ে আজও অর্থোপার্জন করেন অনেক শিল্পীই।

‘স্ট্রিট মিউজ়িকের’ এই ইতিহাস জানেন সৌরজ্যোতি-কৃষ্ণেন্দু। আদতে দু’টি ভিন্ন ব্যান্ডের সদস্য হলেও গান শোনাতে স্টেজের থেকে তাঁদের বেশি পছন্দ রাজপথ। কারণ, এখানে শ্রোতা এবং শিল্পীর মধ্যে কোনও ব্যবধান নেই। নেই ক্যাসেট-সিডি-মোবাইল অ্যাপের আড়াল। তাই খানিকটা ব্যঙ্গ করে নিজেরাই যুগলবন্দির নাম রেখেছেন ‘থার্ড স্টেজ’। কৃষ্ণেন্দুর ব্যাখ্যা, ‘‘এখানে আমরা যেখানে খুশি, যখন খুশি গান করি। সে দিন লেকের ধারে আড্ডা দিতে গিয়ে মনে হল ওখানেই গান করি। ব্যস, শুরু করে দিলাম। লোকেও শুনতে লাগলেন।’’

তবে বাস্কিং করার ভাবনা প্রথম আসে সৌরজ্যোতির মাথায়। যা টাকা ওঠে, তাতে হাতখরচ মিটিয়ে ইনস্ট্রুমেন্ট ঠিক রাখার কাজ হয়ে যায়। পাঁচ বছর বয়স থেকে বেহালায় হাত পাকানো সৌরজ্যোতির রাস্তায় গানবাজনা করতে দ্বিধা না থাকলেও প্রথমে সঙ্কোচ হত কৃষ্ণেন্দুর। ‘‘জানতাম না লোকে কী ভাবে নেবেন। তির্যক মন্তব্যও শুনেছি। লোকে অবাক হয়ে দেখতেন, হঠাৎ রাস্তায় গিটার বার করে টুংটাং করছি। তবে গান ধরলে কিছু মনে থাকত না।’’ —অকপট গায়ক।

টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে তাঁদের গাওয়া ‘হলুদ পাখি’ গানের ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পর থেকে পরিচিতি বাড়ে ‘থার্ড স্টেজ’-এর। আজও তাঁরা ওই গান গাইলে পথচলতি মানুষ থমকে দাঁড়াবেনই। কেউ কেউ পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত বা দুঃখের গান শোনানোর বায়না করেন। নতুন সঙ্গীও জুটে যায়। কখনও আবার শ্রোতাদেরই কারও হাতে গিটার তুলে দেন কৃষ্ণেন্দু। ‘‘আমাদের সঙ্গে যে কেউ গান করতে চাইছেন, সেটাই খুব ভাল লাগে।’’— বলছেন সৌরজ্যোতি।

তবে শুধু কলকাতার পরিধিতেই আটকে থাকতে চান না এই গানওয়ালারা। আদতে বর্ধমানের ছেলে কৃষ্ণেন্দুর স্বগতোক্তি, ‘‘কলকাতার সব জায়গায় গান গাইব। তার পরে শহরের বাইরে যাব।’’ কিন্তু কখন কোথায় থাকবে ‘থার্ড স্টেজ’, সেটাই রহস্য। ফেসবুক-ফোনে অনেকেই জানতে চান, তাঁদের অনেককে উত্তর দেওয়াও হয়ে ওঠে না। করা হয় না নিজেদের গানের ভিডিয়োও। তবে তাতে দুঃখ নেই। ‘‘না হয়, ফেসবুকই যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে থাক! আমাদের গান শুনতে হলে সামনে আসতে হবে।’’— লাজুক হেসে বলছেন সৌরজ্যোতি।

কথায় কথায় সন্ধ্যা নামে। অন্ধকার ফুটপাত ছেড়ে আলো ঝলমল রাজপথের ভিড়ে ক্রমে মিশে যান এ শহরের দুই গানওয়ালা। হাতে গিটার-বেহালা, আর ‘ঠোঁটে নিয়ে বেঁচে থাকার গান’।

Music Busking Students Third Stage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy