এ বারের শারদোৎসবে অসুর কি বৃষ্টি?
সেপ্টেম্বরের শেষে দুর্গাপুজো। প্রতি বছরই এই সময়ে বৃষ্টি হয়। তবে, চলতি বছরে ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি, পুজোতেও বৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে মণ্ডপসজ্জার কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন শিল্পীরা। কাজ এগোনোর জন্য বৃষ্টির জল আটকানোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে খরচের বহরও অন্যান্য বারের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে সব জায়গায়। সেই সঙ্গে বৃষ্টির জেরে বিঘ্নিত কাজ সময়ের মধ্যে শেষ করা নিয়েও মানসিক অশান্তিতে রয়েছেন শিল্পী থেকে উদ্যোক্তা, সকলেই।
কী ভাবে বাড়ছে পুজোর খরচ?
সল্টলেক ও বরাহনগরের দু’টি পুজোর শিল্পী সন্দীপ মুখোপাধ্যায় জানালেন, বৃষ্টিতে যাতে মণ্ডপের অন্দরের সজ্জা কিংবা প্রতিমার ক্ষতি না হয়, তার জন্য ভাবতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘একটি প্রকাণ্ড মণ্ডপকে ঢাকার খরচই তো বিরাট। মণ্ডপ না ঢাকলে পুজোর সময়ে বৃষ্টিতে প্রতিমা কিংবা থিমের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার উপরে মণ্ডপের বাইরের কাঠামো নির্মাণের জন্য লোহা, কাচের মতো উপকরণ ব্যবহার করছি। যেগুলি বেশ ব্যয়বহুল।’’ শিল্পীরা জানাচ্ছেন, সমস্ত রকম উপকরণ সব সময়ে স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা যায় না। কিছু জিনিস অনেক দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বৃষ্টির কারণে সেই সব উপকরণ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শরৎ বসু রোড এলাকার পদ্মপুকুরের একটি পুজোর শিল্পী মানস রায় জানালেন, বৃষ্টির কারণে এ বার শিল্পীরা মানসিক এবং আর্থিক, দু’দিক থেকেই চাপের মধ্যে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘মণ্ডপসজ্জার অনেক উপকরণ কলকাতার বাইরে থেকে আনতে হয়। বৃষ্টির কারণে মাঝেমধ্যেই তা সম্ভব হচ্ছে না। এর জেরে ওই সব উপকরণ মণ্ডপে ব্যবহারের কাজও পিছিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মণ্ডপের কাজ শেষ করতে গিয়ে বাড়তি শ্রমিকের প্রয়োজন হচ্ছে। তাঁরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন, তার জন্য ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’’
কুমোরটুলিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অতি বৃষ্টির কারণে প্রতিমা তৈরির কাজ সময় মতো শেষ করতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন মৃৎশিল্পীরাও। যে কারণে কপালে ভাঁজ পড়েছে পুজোর উদ্যোক্তাদেরও। বর্তমানে বহু বড় বড় পুজোর প্রতিমাসেখানকার মণ্ডপের ভিতরেই তৈরি হয়। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, স্যাঁতসেতে আবহাওয়ায় প্রতিমার রং শুকোতে পাখা ও বেশি পাওয়ারের বাল্বব্যবহার করতে হচ্ছে। যে কারণে বিদ্যুতের বিল চড়ে যাচ্ছে। আবার বৃষ্টির কারণেই সব সময়ে সব আলো জ্বেলে কাজ করা যাচ্ছে না। মানিকতলার একটি মণ্ডপে কাজের বরাত পাওয়া বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী গোপাল সাহার কথায়, ‘‘পুজো যত এগিয়ে আসছে, ততই রাত জেগে কাজ চলছে মণ্ডপগুলিতে। রাতের দিকে ভারী বৃষ্টি হলে কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে শর্ট সার্কিট হওয়ার ভয়ে। আমার দু’টি বড় আলো বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে ইতিমধ্যেই।’’
আবার বৃষ্টির ভ্রুকুটিকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না এমন বহু মানুষ, যাঁদের কাছে পুজোর চারটি দিন রুটি-রুজির জন্য অত্যন্ত জরুরি। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী চত্বরে প্রতি বছর পুজোয় মোমোর অস্থায়ী দোকান দেন লক্ষ্মীকান্তপুরের বাসিন্দা বিধান মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘এ বারে যা নিম্নচাপ আর বৃষ্টি দেখছি, তাতে সত্যিই চিন্তায় আছি এই ভেবে যে, পুজোর চার দিন কী হবে? লোকজন ঠাকুর দেখতে বেরোতে না পারলে অনেক টাকার ক্ষতি হবে।’’ পুজোর উদ্যোক্তারা বৃষ্টির কারণে খরচ বৃদ্ধির বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অনেকে এ-ও জানালেন যে, এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে, তা আগাম ধরে নিয়েই খরচের হিসাব করেছেন। কিন্তু তাতেও উদ্বেগ কাটছে না। তাঁদের আশঙ্কা, বৃষ্টির কারণে মণ্ডপে দর্শক সমাগমই যদি না হয়, তা হলে তো সব পরিশ্রম, উদ্যোগ মাঠে মারা যাবে।
পুজোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সহ-সভাপতি শাশ্বত বসুর কথায়, ‘‘বৃষ্টি যে এ বার প্রতিকূলতা তৈরি করতে পারে, তা ধরে নিয়েই আমরা কাজে নেমেছি। মণ্ডপ ঢেকে কাজ করতে গিয়ে খরচ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু যেটা নিয়ে চিন্তা বেশি, তা হল, বহু মানুষ মণ্ডপের বাইরে বিভিন্ন ধরনের স্টল দেন। তাঁরা আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। বৃষ্টির কারণে তাঁরা ব্যবসা করতে না পারলে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)