স্কুলের দরজা আটকে পড়ে রয়েছে লোহার বড় বড় খাঁচা, সিমেন্টের বস্তা, সামনে দাঁড়িয়ে পেল্লাই ক্রেন। গনগনে রোদ মাথায় ক্ষুদে পড়ুয়াদের যাতায়াত তাই কার্যত বন্ধ। স্কুল ছুটির পরে কোনও রকমে টপকে আসতে গিয়ে হাত-পা ছড়ে যাচ্ছে। সৌজন্যে স্থানীয় কাউন্সিলরের ‘গা-জোয়ারি’।
ঘটনাস্থল কুঁদঘাট। এখানে ব্যানার্জি পাড়া এবং চন্ডী ঘোষ রোডকে জুড়তে টালি নালার (আদিগঙ্গা) উপরে তৈরি হচ্ছে পায়ে চলার সেতু। আর তার জেরেই নেতাজি মেট্রো স্টেশন লাগোয়া মনসুর হাবিবুল্লা মেমোরিয়াল স্কুলের মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করাই দায়। স্কুলের গেটের সামনে ফেলে রাখা হয়েছে ব্রিজ তৈরির যন্ত্রপাতি।
বেসরকারি এই স্কুলে প্রি-নার্সারি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে। বুধবার ওই স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, দুপুর পৌনে বারোটা নাগাদ প্রি নার্সারির ছুটির ঘণ্টা বাজতেই হুলুস্থুল কাণ্ড। পড়ে থাকা লোহার উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ল কিছু ক্ষুদে। পাশ কাটিয়ে বেরোতে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেল আরও কয়েকজনের। পড়ে থাকা লোহার খাঁচায় আটকে পোশাক ছিঁড়ে গেল এক শিক্ষিকার। সপ্তাহখানেক ধরে এ ভাবেই স্কুলে ঢুকতে ও বেরোতে হচ্ছে পড়ুয়া-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী-অভিভাবকদের। সমস্যা এমন পর্যায়ে যায় যে মঙ্গলবার কয়েকজন অভিভাবকই স্কুলের দরজার সামনে থেকে ওই লোহার খাঁচা সরিয়ে অন্যত্র রেখে দেন। কিন্তু বুধবার দেখা যায়, ফের দরজা আটকে ফেলে রাখা হয়েছে ওই খাঁচা। শুধু তাই নয়, ফের যাতে কেউ ওই যন্ত্রপাতি সরাতে না পারেন, সে দিকে নজর রাখতে নর্দমার পাশে বসে থাকতে দেখা যায় কয়েকজনকে। কারা তাঁরা? স্থানীয় সূত্রে খবর, এলাকায় তাঁরা তৃণমূলের সমর্থক বলেই পরিচিত।
মঙ্গলবার অভিভাবকদের সঙ্গে বচসা হওয়ার সময়ে সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে এসেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু পড়ুয়াদের সমস্যায় ফেলে কেন এই ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা? এলাকা সূত্রে খবর, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের পছন্দের কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করাতে বিভিন্ন ভাবে চাপ দেওয়া হত স্কুল-কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সেই চাপের কাছে মাথা নত করতে না চাওয়ায় এখন ঘুরিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে শাসকদল। এই অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মিতালিদেবী।
বুধবার দুপুরে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রী অভিভাকদের অবস্থাটা ঘণ্টাখানেক ধরে দেখে আসার পরে যখন স্থানীয় কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁর নির্লিপ্ত জবাব, ‘‘কই কোথাও তো কোনও সমস্যা দেখছি না। মঙ্গলবার একটু সমস্যা হয়েছিল। আমি গিয়ে মিটিয়ে এসেছি।’’
মেট্রো স্টেশন লাগোয়া ওই অঞ্চলে একাধিক এমন ফুটব্রিজ রয়েছে যা ওই দুই এলাকাকে যুক্ত করে রেখেছে। বাস-ট্যাক্সি-অটোস্ট্যান্ড মিলে এলাকা এমনিই ভীষণ ঘিঞ্জি। তার মধ্যে স্কুলের প্রবেশপথ আটকে, পড়ুয়াদের সমস্যায় ফেলে এই ব্রিজ তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে
প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সকলেই।
ওই স্কুলের অধ্যক্ষা প্রতুলা রায় জানান, জানুয়ারি মাসের শেষে কলকাতা পুরসভার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতর থেকে একটি চিঠিতে এই ব্রিজ তৈরির কথা জানানো হয়েছিল। তার পরেই বিষয়টির প্রতিবাদ করে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ জানাই। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে পড়ুয়াদের সমস্যা সবার আগে। এমন একটা ব্যস্ত এলাকায় স্কুল। বাচ্চাদের প্রবল অসুবিধা করে সেখানে উন্নয়ন দেখানোর কোনও যুক্তি নেই।’’
স্কুল কর্তৃপক্ষের কথায়, ওই এলাকায় কিছু হাত অন্তরই রয়েছে দুই রাস্তার সংযোগকারী মেট্রোরেলের বেশ কয়েকটি ব্রিজ। এই অবস্থায় অতিরিক্ত ওই ব্রিজ আরও যানজট বাড়াবে এবং প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই স্কুল। এ দিকে মিতালীদেবী বলেন, ‘‘নতুন কাজ হলে প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হবেই। তা বলে সরকারের কাজ তো বন্ধ করে দিতে পারি না। অধ্যক্ষা যদি সহযোগিতা না করেন, তাহলে এ ভাবেই কাজ চলবে।’’
এই ব্রিজ নির্মাণের পিছনে অবশ্য সিন্ডিকেট-রাজের ছায়াও দেখছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘এই ব্রিজের কোনও প্রয়োজনীয়তাই তো দেখছি না। আসলে উন্নয়নের নাম করে আমাদেরই টাকা নয়-ছয়ের আরেকটা বন্দোবস্ত করা হচ্ছে মাত্র।’’
এই স্কুলেরই গভর্নিং বডির সভাপতি বিদায়ী প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী নূরে আলম চৌধুরী। তাঁর স্ত্রী মমতাজ সঙ্ঘমিতা বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ। মমতাজদেবীর বাবা মনসুর হাবিবুল্লা ছিলেন বামনেতা এবং সেই জমানার আইনমন্ত্রীও। তাঁর স্মৃতিতেই তৈরি এই স্কুল। ফলে স্কুলের গভর্নিং বডির সম্পাদক মমতাজ সঙ্ঘমিতা বিষয়টি নিয়ে বেশ দ্বন্দ্বেই। এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘‘সবার যদি এতই অসুবিধা হচ্ছে তবে গণ প্রতিবাদপত্র দিক। দুই এলাকাকে যোগ করতে হলে তো ব্রিজ বানাতেই হবে।’’
কিন্তু স্কুলের দরজা আটকে এই উন্নয়ন করতে গিয়ে তো আখেরে সমস্যায় পড়ছে পড়ুয়ারাই। ‘‘এ বিষয়ে এখন কিছুই বলবো না। যা বলার ভোটের পরে’’— বলেই ফোন কেটে দেন তিনি। তার কিছু পরে নিজেই ফোন করে আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘অসুবিধা যে হচ্ছে তা তো বুঝতেই পারছি। কী করবো বলুন! বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রককেও জানিয়েছি। কিন্তু কাজ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এ নিয়ে ভোটের আগে আর কোনও কথা নয়।’’