Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দিনভর ঠুঁটো পুলিশ গুলি খেল শেষ লগ্নে

দিনভর শহরের নানা প্রান্তে দাপিয়েছে বহিরাগতরা। ভোটপর্ব চলাকালীন বহু জায়গায় বোমাবাজি, গুলি চালানো, বিরোধী দলের এজেন্ট-কর্মী-প্রার্থীকে মারধর-নিগ্রহ, বুথ অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে অজস্র। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সে ভাবে সক্রিয় না হয়ে কার্যত হাত গুটিয়েই বসে ছিল পুলিশ। আর সেই পুলিশই ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পরে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলি খেয়ে বসল! এ দিনের পুরভোটে এটাই ছিল শহরের সব থেকে বড় ঘটনা।

সাব ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গিরিশ পার্ক এলাকায় পুলিশি তৎপরতা। শনিবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

সাব ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গিরিশ পার্ক এলাকায় পুলিশি তৎপরতা। শনিবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

দিনভর শহরের নানা প্রান্তে দাপিয়েছে বহিরাগতরা। ভোটপর্ব চলাকালীন বহু জায়গায় বোমাবাজি, গুলি চালানো, বিরোধী দলের এজেন্ট-কর্মী-প্রার্থীকে মারধর-নিগ্রহ, বুথ অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে অজস্র। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সে ভাবে সক্রিয় না হয়ে কার্যত হাত গুটিয়েই বসে ছিল পুলিশ। আর সেই পুলিশই ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পরে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলি খেয়ে বসল! এ দিনের পুরভোটে এটাই ছিল শহরের সব থেকে বড় ঘটনা।

ঠিক যেন বছর দুয়েক আগে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনের ঘটনা। সে দিন গুলিবিদ্ধ সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছিল। এ দিন সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।

২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের উপলক্ষ ছিল হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আর শনিবার গিরিশ পার্কে গুলি চলল কলকাতা পুরসভার নিবার্চনে। গার্ডেনরিচের ঘটনায় গোলমালের জন্য এক তৃণমূল কাউন্সিলার ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের অভিযুক্ত করেছিল পুলিশ। এ দিনের ঘটনায় পুলিশ এলাকার প্রাক্তন এক তৃণমূল কাউন্সিলারের ঘনিষ্ঠদের দিকে আঙুল তুলেছে।

গিরিশপার্ক থানার গুন্ডা দমন শাখার অফিসার জগন্নাথ মণ্ডলকে সিএমআরআই-তে ভর্তি করা হয়েছে। এ দিন তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাইরে এসে মমতা জানান, জগন্নাথবাবুর ডান কাঁধের তলায় গুলি লেগেছে। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গুলিটি জগন্নাথবাবুর ডান পাঁজরের পিছনে বিঁধে রয়েছে। অস্ত্রোপচার করে সেটি বের করতে হবে। গুলি লাগার পরে জগন্নাথবাবুর শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁকে কয়েক দিন আইসিসিইউ-তে রেখে পর্যবেক্ষণ করার পরে গুলি বের করা হবে। কার্ডিওথোরাসিক চিকিৎসক অবনী বিশ্বাসের অধীনে চিকিৎসা চলছে তাঁর। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পাঁজরের বাঁ দিকে গুলিটি লাগলে জগন্নাথবাবুর জীবনের ঝুঁকি ছিল।

কী ভাবে গুলিবিদ্ধ হন জগন্নাথবাবু? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গিরিশ পার্ক এলাকায় একটি ছোট ধস্তাধস্তির ঘটনার জেরে তাঁর গুলি লাগে। তবে ধস্তাধস্তির সময়ে কে গুলি চালাল, তা মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর পাশে দাঁড়ানো পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ জানাতে চাননি। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘আমরা কয়েক জনকে আটক করেছি।’’ তারা কোনও রাজনৈতিক দলের কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্য এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি।

কী ঘটেছিল সিংহীবাগানে?

কলকাতার পুরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিংহীবাগানে গিয়ে জানা গেল, এ দিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ রাজেন্দ্র মল্লিক রোডের কংগ্রেস কার্যালয়ের সামনে শুরু হয় বোমাবাজি। ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী দীপক সিংহের অভিযোগ, ‘‘আমি সিংহীবাগানের দলীয় কার্যালয়ে বসেছিলাম। আচমকাই সামনের রাস্তায় বোমাবাজি শুরু হয়। আশপাশের লোকজন বেরিয়ে এলে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়।’’ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও তৃণমূলের হামলার প্রতিবাদে গিরিশ পার্কে রাস্তা অবরোধ করেন কংগ্রেসের সমর্থকরা। পরে পুলিশ অবরোধ তুলে দেয়।

এর পরের গোলমাল ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পরে। তখন বিকেল সাড়ে চারটে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বারাণসী ঘোষ লেন ও সিংহীবাগান মোড়ের দু’দিক থেকে বেশ কিছু দুষ্কৃতী এলাকায় ঢুকে ভেঙে দেয় কংগ্রেসের একটি অফিস। তিনটি বোমাও পড়ে। সেই সময় বারাণসী ঘোষ রোডের দিক থেকে জনা দশেক পুলিশ দুষ্কৃতীদের দিকে এগিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘তখনই ওই পুলিশদের লক্ষ করে গুলি চালায় এক জন। গুলি লাগে জগন্নাথবাবুর শরীরে। আমরা দেখলাম, আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন উনি।’’

ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মীর মন্তব্য, ‘‘প্রথম ঘটনার পরে আমরা যেমন নিষ্ক্রিয় ছিলাম, এ বারেও তেমন থাকলে জগন্নাথবাবুকে গুলি খেতে হত না! আমরা যে ওদের দিকে এগিয়ে যাব, তা ভাবতে পারেনি দুষ্কৃতীরা।’’ দুষ্কৃতীরা কোন দলের, সে ব্যাপারে অবশ্য পুলিশ কর্মীরা মুখ খুলতে চাননি। তবে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ, কংগ্রেসের নেতা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেরই অভিযোগ, তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলার সঞ্জয় বক্সীর লোকেরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।

এই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য সঞ্জয়বাবুর। তা হলে তাঁর নাম কেন উঠল? প্রাক্তন ওই তৃণমূল কাউন্সিলারের কথায়, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দল এলাকা দখলের জন্য গুলি চালায়। কিন্তু সিংহীবাগানের ওই এলাকায় তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক শক্ত। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল কেন গুলি চালাবে, তা আমি বুঝতে পারছি না।’’ সঞ্জয়বাবুর অভিযোগ, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে অপদস্থ করতেই কিছু পুলিশ অফিসার আমাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে নানা মন্তব্য করছেন।’’

পুলিশ সূত্রে খবর, ওই ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তারা কোন দলের, সে ব্যাপারে চুপ পুলিশ। এমনকী ঘটনার আধ ঘণ্টা পরেও লালবাজারে ঘটনার পুরো রিপোর্ট পৌঁছয়নি! পাঁচটায় সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশ কমিশনারকে গিরিশ পার্কের ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে ওই ঘটনার রিপোর্ট আসেনি!’’ শাসক দল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা গুলি চালানোয় কর্তারা তেমন আমল দিচ্ছে না বলে পুলিশের নিচুতলা অভিযোগ তুলতে শুরু করার পরে তৎপর হয় লালবাজার। তবে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, সঠিক সময়েই লালবাজার খবর পৌঁছেছিল। সাংবাদিক বৈঠকে ব্যস্ত সিপি-কে তা জানানো যায়নি।

এ দিন সিংহীবাগান ছাড়া অন্য তিনটি জায়গা থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ এসেছে। সকাল সাড়ে ১০ টায় বেনিয়াপুকুরে বুথ দখলকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও কংগ্রেস সমর্থকদের লড়াইয়ে গুলি চলে বলে অভিযোগ। গুলিতে একটি গাড়ির কাঁচ ফুটো হয়ে যায়। তবে পুলিশের দাবি, গুলি নয়, কাঁচ ফুটো হয়েছে বোমার টুকরোয়। ওই সংঘষের্র সময়ে ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী মহম্মদ নাদিমের হাত ভেঙে যায় বলে অভিযোগ। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী কাইজার জামিল বলেন, ‘‘কংগ্রেসের ছেলেরাই গুলি, বোমা ছুঁড়েছে। নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় আহত হন কংগ্রেস প্রার্থী।’’

এ দিন গুলি চলেছে ৯৯ ওয়ার্ডের নেতাজিনগর থানা এলাকার বিদ্যাসাগর কেয়াবাগানেও। দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ কেয়াবাগানের বিদ্যাসাগর বিদ্যানিকেতনে তখন ভোট চলছিল পুরোদমে। আরএসপি-র এজেন্ট বাবলা ঘোষের অভিযোগ, তিনি আচমকাই বুথের ভিতরে কয়েক জন বহিরাগতকে ঢুকতে দেখে পুলিশকে জানান। কিন্তু লাভ না হওয়ায় তিনি নিজে বাধা দিতে গেলে তাঁকেই বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়! তখন বাবলাবাবু চেঁচামেচি করলে বহিরাগতরা বুথের বাইরে এসে শূন্যে গুলি চালায়। বহিরাগতরা তৃণমূলের হয়ে কাজ করছিল বলে অভিযোগ আরএসপি-র। তৃণমূল প্রার্থী রেখা দে অবশ্য বলেন, ‘‘আমি গুলি চালানোর কথা শুনিনি।’’

দুপুরে মধ্য কলকাতার চৌরঙ্গি লেনে সিপিএম নেতা ফুয়াদ হালিমকে লক্ষ করে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। তবে গুলি কারও গায়ে লাগেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE