Advertisement
২১ মে ২০২৪

অক্সিটাউনে স্ত্রী ও দুই সন্তান-সহ ৪টি জীবন নষ্টের মাসুল মৃত্যুদণ্ড

নিজে ছিলেন নেপথ্যে। স্ত্রীকে খুন করার জন্য ‘সুপারি’ দিয়েছিলেন অন্যদের। ঠাকুরপুকুরের অক্সিটাউনে সেই গৃহবধূ এবং বাড়ির পরিচারিকাকে খুনের ঘটনায় গৃহকর্তা অভীক ঘোষকে বৃহস্পতিবার মৃত্যুদণ্ড দিল আলিপুর আদালত। আর ওই খুনের ঘটনায় যাকে কাজে লাগানো হয়েছিল, সেই সোমনাথ তাঁতিকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। গত মঙ্গলবারেই জোড়া খুনে ওই দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।

আলিপুর আদালতের বাইরে অভীক ঘোষ এবং সোমনাথ তাঁতি। বৃহস্পতিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

আলিপুর আদালতের বাইরে অভীক ঘোষ এবং সোমনাথ তাঁতি। বৃহস্পতিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

নিজে ছিলেন নেপথ্যে। স্ত্রীকে খুন করার জন্য ‘সুপারি’ দিয়েছিলেন অন্যদের। ঠাকুরপুকুরের অক্সিটাউনে সেই গৃহবধূ এবং বাড়ির পরিচারিকাকে খুনের ঘটনায় গৃহকর্তা অভীক ঘোষকে বৃহস্পতিবার মৃত্যুদণ্ড দিল আলিপুর আদালত। আর ওই খুনের ঘটনায় যাকে কাজে লাগানো হয়েছিল, সেই সোমনাথ তাঁতিকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। গত মঙ্গলবারেই জোড়া খুনে ওই দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।

২০১০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে অভীক ঘোষের স্ত্রী মৌসুমী ঘোষ এবং তাঁদের পরিচারিকা পারুলবালা ঘোষের গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। দুই মহিলাকেই হাত ও মুখচোখ বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নলি কেটে খুন করা হয়েছিল। তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, মৌসুমী-হত্যার ঘটনাটি দেখে ফেলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে পরিচারিকাকেও খুন করা হয়। ওই সময় বাড়িতে মৌসুমীর দুই শিশুসন্তানও ছিল। ঘটনার দিন ওই বাড়ি থেকে টাকা এবং বেশ কিছু সোনার গয়না খোয়া গিয়েছিল।

এই মামলার রায় শোনার জন্য এ দিন বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলালের এজলাসে। আদালত মনে করে, এটি বিরলতম ঘটনা। তাই মৃত্যুদণ্ড। কেন বিরলতম? আদালতের পর্যবেক্ষণ: ঘটনাস্থলে না-থেকেও অভীক রীতিমতো পরিকল্পনা করে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল।

রায়ের পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অভীক ঘোষ বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘স্যার, আমি জানি না, এই ঘটনা কী করে ঘটল। অধিকাংশ সময় চাকরির জন্য আমি বাইরেই থাকতাম। এই ঘটনায় আমি কোনও ভাবেই যুক্ত নই।’’ এর পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন অভীক। বিচারক তাঁকে বলেন, ‘‘আপনার জন্যই আপনার পরিবারের চার-চারটি জীবন নষ্ট হল। স্ত্রী খুন হলেন। ছেলেমেয়েদের জীবন নষ্ট হল। নষ্ট হল আপনার জীবনও।

সোমনাথ তাঁতিও এ দিন নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। তাঁর বক্তব্য শোনার পরে বিচারক বলেন, ‘‘আপনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। জেলে গিয়ে নিজেকে সংশোধন করে ভাল মানুষ হয়ে সুস্থ সমাজে ফিরে আসুন।’’ সোমনাথ তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘পরিবারে আমি একমাত্র রোজগেরে। বাড়িতে স্ত্রী আছেন। মা-বাবা আছেন। সন্তান খুব ছোট। এমন সাজা দেবেন না, যাতে সংসারটা ভেসে যায়।’’ আর্জি শুনে বিচারক বলেন, ‘‘উচ্চ আদালত রয়েছে। সেখানে আবেদন করুন।’’


অক্সিটাউনের বাড়ি। (ইনসেটে) পারুলবালা এবং মৌসুমী ঘোষ। — নিজস্ব চিত্র।

অভীক স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অক্সিটাউনের যে-বাড়িতে থাকতেন, সেখানে এখন আগাছার জঙ্গল। এ দিন রায়ের পরে ওই দোতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে থেকে তালা দিয়ে দরজা আটকানো। তালাটিতে মরচে পড়েছে। প্রতিবেশীরা জানান, তিন বছর ওই বাড়ির তালা খোলা হয়নি। অভীকের মা সন্ধ্যাদেবী আগে ওই বাড়িতে আসতেন। পরে পুলিশ তাঁকে আসতে নিষেধ করে দেয়। তার পর থেকে ওই বৃদ্ধাকে আর ওই বাড়িতে দেখতে পাননি প্রতিবেশীরা। পাড়ার লোকজনের কাছে বাড়িটি এখন ‘অক্সিটাউনের ভুতুড়ে বাড়ি’ বলে চিহ্নিত। ওই বাড়ির থেকে কিছু দূরেই পাল পরিবারের ফাঁকা বাড়িটিও (১৯৯৯ সালে বাড়ির চার জন যেখানে খুন হন) ভুতুড়ে বাড়ির তকমা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অভীকের বাড়ি থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে থাকেন তাঁর দিদি চন্দ্রিমা চৌধুরী। তিনি পেশায় চিকিৎসক। এ দিন ওই বাড়িতে গিয়ে অনেক ক্ষণ ডাকাডাকির পরে এক জন বাইরে এসে বললেন, ‘‘বাড়িতে কেউ নেই।’’ পড়শিরা জানান, মৌসুমী খুন হওয়ার পরে তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে কার কাছে রাখা হবে, তা নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়েছিল। সেই সময় দেবকুমার তিওয়ারি নামে এক পড়শি প্রায় ১৬ দিন শিশু দু’টিকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। পরে থানায় গিয়ে বাচ্চা দু’টিকে অভীকের হাতে তুলে দেন তিনি। তার পরে তাদের কী হয়েছে, পড়শিদের কেউই তা জানেন না।

মৌসুমীর সঙ্গেই খুন হন তাঁদের পরিচারিকা পারুলবালা। তাঁর বাড়ি পাশের হাজারিপাড়ায়। পারুলবালার ছেলে রবি ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘দু’বছর ধরে মা ওই বাড়িতে কাজ করছিলেন। শেষ দিকে প্রায়ই বাড়িতে ফিরে বলতেন, ‘আর ওই বাড়িতে কাজ করতে যাব না। বৌটাকে খুব মারধর করে। সহ্য করা যায় না’।’’ বিধবা পারুলবালার রোজগারেই তখন তাঁদের সংসার চলত বলে জানান রবিবাবু। এখন বাসের কন্ডাক্টরের কাজ করেন তিনি। এ দিন রায় ঘোষণার সময় রবিবাবুও হাজির ছিলেন আদালতে। তিনি বলেন, ‘‘এত দিনের লড়াই সফল হল।’’

আদালতে এসেছিলেন মৌসুমীর বাবা শঙ্কর দত্তও। তিনি জানান, দেখাশোনা করেই তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অভীকের। আগেও যে ওই যুবকের বিয়ে হয়েছিল, তখন তাঁরা সেটা জানতেন না। বিয়ের পর থেকেই মৌসুমীর উপরে অত্যাচার করতেন অভীক। বারবার বলেও কোনও সুরাহা হয়নি। নদিয়ার পলাশির বাসিন্দা শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘এক বার মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু ছেলেমেয়েকে মানুষ করবে বলে ও আবার জোর করেই স্বামীর ঘরে চলে গিয়েছিল। কেন যে তখন ওর কথা শুনেছিলাম!’’ আদালতের রায়ে তাঁকে বেশ কিছুটা আশ্বস্ত মনে হল। তিনি বলেন, ‘‘সত্যের জয় হল। অভীকেরা যদি উচ্চ আদালতে যায়, আমিও যাব। এই অন্যায়ের শেষ দেখে ছাড়ব।’’

শঙ্করবাবু জানান, ঘটনার পরে মৌসুমীর ছেলেকে নিজের কাছেই রেখেছেন তাঁর শাশুড়ি সন্ধ্যাদেবী। কিন্তু মেয়েটির কোনও খোঁজ নেই। তিনি বলেন, ‘‘নাতি-নাতনিকে কাছে পেতে আদালতের কাছে আবেদন করেছি। দেখি কী হয়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE