মারমুখী, প্রায়-উন্মত্ত একদল মানুষ। বিভিন্ন ঘটনায় তাদের মুখগুলো শুধু বদলে যায়, চরিত্র একই থাকে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে তারা যে কোনও সময়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ফেলে পেটানোর ক্ষমতা রাখে।
বছরের পর বছর, একের পর এক একই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঘটনায় সত্যিই চিকিৎসকদের গাফিলতি থাকে কি না, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু সমাজসচেতন মানুষের একটা বড় অংশের এখন প্রশ্ন—ডাক্তারের গাফিলতি আছে কি না, তা প্রমাণের আগেই হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তারদের মারধরের অধিকার কে কাকে দিয়েছে? তবে কি সমাজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিছু অসহিষ্ণু, উচ্ছৃঙ্খল দুষ্কৃতী-মনস্কদের মাধ্যমে, যারা নিয়মকানুনের পরোয়া করে না? নাকি একই রকম ঘটনায় কারও কঠোর শাস্তি হচ্ছে না দেখে এই ধরনের মানুষের সাহস আরও বেড়েছে?
রবিবার গভীর রাতে ফের এমনই এক ঘটনার সাক্ষী হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বেধড়ক মার খান জুনিয়র ডাক্তারেরা। পুলিশ জানায়, নারকেলডাঙা থানার ক্যানাল ওয়েস্ট রো়ডে তোলাবাজির দখল নিয়ে মুকেশ রায় ও অর্জুন সিংহ নামে দু’দল দুষ্কৃতীর মারপিটে গুরুতর জখম হন কয়েক জন। শিয়ালদহ স্টেশন লাগোয়া যে জায়গায় রেলের ওয়াগন থেকে মালপত্র নামিয়ে লরিতে তোলা হয়, সেই স্থানে পার্কিং ফি আদায়ের নামে ওই তোলাবাজি চলে বলে অভিযোগ। আহতদের এনআরএসে নিয়ে যাওয়া হলে কৈলাস রায় (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। তিনি সল্টলেকের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী বলে জানা গিয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, মরণাপন্ন কৈলাসকে হাসপাতালে নিয়ে আসে একটা দল। অভিযোগ, প্রথম থেকেই চলছিল অশ্রাব্য গালিগালাজ। বাঁশ ও লাঠি নিয়ে ইমার্জেন্সিতে ঢুকে মারমুখী জনতা কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হুমকি দেয়, আহতকে না-বাঁচালে চিকিৎসকের ‘চোখে গুলি করে দেওয়া হবে।’ আক্রান্তেরা জানান, তাঁদের চেষ্টা সত্ত্বেও কৈলাসের মৃত্যু হলে তাণ্ডব শুরু হয়। নির্বিচারে চিকিৎসকদের লাথি-ঘুষি মারতে থাকে জনতা, বাঁশ দিয়েও পেটানো হয়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তারকে মারধর করলে আইনে হামলাকারীদের জন্য কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এ রাজ্য কখনওই তার প্রয়োগ দেখেনি বলে আফশোস চিকিৎসকদের। সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসুর মতে, আইন প্রয়োগে উদ্যোগী হলেও কেউ বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। কারণ তাঁর কথায়, ‘‘দুনিয়াটাই এখন দুষ্কৃতীরা চালাচ্ছে। তারা বুঝে গিয়েছে, যা ইচ্ছা করে গেলেও শাস্তি হবে না। তাই রাত ১টা পর্যন্ত পাড়ায় মাইক বাজে, ছেলেমেয়েরা পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে শিক্ষককে পেটায়। জনতাও তাই যখন খুশি হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তারকে মারতে পারে। শাস্তি দূরে থাক, পাঁচ টাকারও জরিমানা হয় না। তাই সাহসও বেড়ে যায়।’’
অন্য ব্যাখ্যা মিলেছে প্রাক্তন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা জয়শ্রী মিত্র ঘোষের কাছে— ‘‘গোটা সমাজেই হিংসা, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ডাক্তারেরা মানুষের সরাসরি সংযোগে থাকেন বলে আঁচ তাঁদের গায়ে বেশি লাগে। এর কোনও সুরাহা অন্তত আমার নজরে আসছে না। পুলিশি প্রহরা বাড়িয়ে কতটা আটকানো যায় দেখতে হবে।’’ আর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ডাক্তারেরা সব অকর্মণ্য, অযোগ্য। ফলে পান থেকে চুন খসলেই রাগ গিয়ে পড়ে তাঁদের উপরে। রক্ষী কম থাকায় সরকারি হাসপাতালে এমন ঘটনা বেশি হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy