—প্রতীকী ছবি।
দশ বছর আগে এ দেশে যত জন থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিলেন, সেই সংখ্যাটা বর্তমানে অনেকটাই বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তথ্য বলছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি দশ জনে এক জন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রতি বছর এ রাজ্যে প্রায় সাত হাজার নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর সন্ধান মিলছে।
প্রশ্ন উঠেছে, রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি কি রোগের বিস্তার তুলে ধরছে? নাকি সচেতনতার ফলে রোগ নির্ণয়ের সংখ্যা বেড়েছে? চিকিৎসকেরা বলছেন, দু’টোই। তাঁদের কথায়, গোড়াতেই থ্যালাসেমিয়া ঠেকাতে গত এক দশকে সে ভাবে প্রচার হয়নি বা মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছয়নি। যে ভাবে এইচআইভি সচেতনতায় ‘বুলাদি’ প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, থ্যালাসেমিয়া আটকাতে তেমন প্রচার চান চিকিৎসকেরা। আবার এর পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ দেখে মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসছেন, তাই সামনে আসছে সংখ্যাটা।
এখনও রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের থেকে বিয়ের আগে ঠিকুজি বিচার করাতেই মানুষের আস্থা বেশি। থ্যালাসেমিয়া রোধের আন্দোলনে শামিল, অস্থি চিকিৎসক রামেন্দু হোমচৌধুরী বলেন, ‘‘সচেতনতা প্রচারের লক্ষ্য ছিল, হরোস্কোপ থেকে মাইক্রোস্কোপে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো। তাতে আমরা ব্যর্থ। স্বামী-স্ত্রীর এক জন থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও অন্য জন স্বাভাবিক হলে সন্তান সুস্থ হবে। কিন্তু দু’জনেই বাহক হলে প্রতি বার সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে শিশুর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ২৫ শতাংশ। তাই হিমোগ্লোবিনের এইচপিএলসি পরীক্ষা জরুরি। অথচ সেখানেই পিছিয়ে সমাজ।’’
দু’জন বাহকের বিয়ে হলেও বিপদ ঠেকানো যায়, বলছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের পরামর্শ, সে ক্ষেত্রে প্রি-নেটাল টেস্ট করে গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কি না, তা জানতে হবে । সেই পরীক্ষায় গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের মধ্যে জরায়ু থেকে রস নিয়ে ইউএসজি করাতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ। থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় এবং প্রি-নেটাল টেস্ট দু’টোই এ রাজ্যে সরকারি পরিকাঠামোয় হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে প্রি-নেটাল টেস্ট হয় বিনামূল্যে। এন আর এস-এর হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান, চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালে প্রতি মাসে ২৫-৩০টি পরিবারের প্রি-নেটাল টেস্ট হয়। তবে যেখানে সচেতনতার কথা বলছি, সেখানে পরিকাঠামো আরও বাড়ানো উচিত।’’ তাঁর মতে, এখনও থ্যালাসেমিয়া নিয়ে বহু শিক্ষিত মানুষের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ও ঘৃণা কাজ করে। যার জেরে আক্রান্তদের একাংশ সমাজে কোণঠাসা থাকেন।
চিকিৎসক মহলের মতে, থ্যালাসেমিয়ার নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি আগের থেকে এখন অনেকটাই উন্নত। এর ফলে আক্রান্তদের গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সচেতনতার প্রচারে সেটাই সাফল্য নয়। সাফল্য তখনই আসবে, যখন আক্রান্তের সংখ্যা ঠেকানো যাবে।
রামেন্দুবাবুর মতে, ‘‘আমাদের বুঝতে হবে, অন্য রোগের চিকিৎসা করতেও রক্তের যথেষ্ট প্রয়োজন হয়। অথচ মোট রক্তের প্রায় ৬০ শতাংশ খরচ হয় শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য। এখনও যদি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের সংখ্যায় রাশ টানা না যায়, তবে ভবিষ্যতে অন্য রোগের চিকিৎসায় রক্ত ও হাসপাতালের শয্যা, দু’টোই অমিল হবে। কারণ, এই অসুখে হৃৎপিণ্ড, লিভার, ফুসফুস, যকৃৎ প্রভৃতি অঙ্গে লোহা জমে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সে জন্য হাসপাতালে রেখে রোগীর চিকিৎসা করাতে হয়।’’
প্রান্তরবাবু জানান, স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের এইচপিএলসি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে সাত বছর আগে স্বাস্থ্য ভবন থেকে শিক্ষা দফতরে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমেই।
সচেতনতার প্রচারে জোট বাঁধতে তাই আগামী ১৯ নভেম্বর একটি সংস্থার পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছে এক অনুষ্ঠানের। সেখানে অংশ নিতে পারবেন যে কেউ। থাকবেন সমাজের বিশিষ্ট জনেরা, দেশ-বিদেশের চিকিৎসকেরা। সদ্যোজাত অথবা স্কুলপড়ুয়াদের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের পরীক্ষা যাতে বাধ্যতামূলক করা হয় তার জন্য কড়া পদক্ষেপ করতে ও সচেতনতায় জোরদার প্রচারের জন্য ওই দিন সরকারকে আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুরোধ করা হবে ওই সংস্থার পক্ষ থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy