Advertisement
১৮ মে ২০২৪
দুর্গাচরণ ডাক্তার রোড

বিবিধের মিলনেই বাঁধা আছে এলাকা

এই পাড়ায় নানা জাতি নানা ধর্মের সমন্বয়। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান থেকে বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া একেবারে নিশ্চিন্তে মনের সুখে এখানে বসবাস করে। আসলে বংশ পরম্পরায় বসবাস করতে করতে এঁরা এক জাতি এক প্রাণ হয়ে গিয়েছেন।

শঙ্করকুমার নাথ
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০১:৫১
Share: Save:

এই পাড়ায় নানা জাতি নানা ধর্মের সমন্বয়। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান থেকে বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া একেবারে নিশ্চিন্তে মনের সুখে এখানে বসবাস করে। আসলে বংশ পরম্পরায় বসবাস করতে করতে এঁরা এক জাতি এক প্রাণ হয়ে গিয়েছেন। এটাই গড়ে তুলেছে এ পাড়ার সম্প্রীতিপূর্ণ, বর্ণময় চরিত্র।

তালতলা অঞ্চলের দুর্গাচরণ ডাক্তার রোড সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড থেকে পাকদণ্ডির মতো ঘুরে কিছু শাখা প্রশাখাকে আলিঙ্গন করে এক দিকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে, অন্য দিকে ডক্টর লেনে গিয়ে মিশেছে।

এখানে বাড়ির সংখ্যাই বেশি। কিছু কিছু ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, লোহার কাজ করা বারান্দা আর রঙিন কাচ বসানো খিলানও দেখা যায়। এখনও সে ভাবে ফ্ল্যাট সংস্কৃতি থাবা বসাতে পারেনি। এখনও হারায়নি পাড়ার সাবেক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ।

নানা কারণে যাঁরা পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন তাঁরা আজও নাড়ির টানে ফিরে আসেন উৎসবে অনুষ্ঠানে। যাঁরা থাকেন তাঁরা আজও সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন। প্রবীণদের পাশাপাশি পাড়ার যুব সম্প্রদায়ও এতে পিছিয়ে নেই।

আমাদের পাড়াটা সব সময়ই জমজমাট। বেশি রাত পর্যন্ত মানুষের আনাগোনা লেগে থাকায় চুরির ঘটনাও সচরাচর ঘটে না। সময়ের সঙ্গে উন্নত হয়েছে নাগরিক পরিষেবা। নিয়মিত হয় রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ। বসেছে জোরালো আলো। তবে রাতের দিকে যখন দেখি রাস্তার কোথাও কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আবর্জনা তখন খারাপ লাগে। মনে হয় পাড়াটা আরও পরিচ্ছন্ন থাকলে ভাল হত। স্থানীয় কাউন্সিলর ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় এলাকার উন্নয়নে সচেষ্ট।

পাড়ার রাস্তাগুলি খুব একটা চাওড়া না হওয়ায় গাড়ি পার্কিং-এর সমস্যা হয়। তার উপর বেশির ভাগ বাড়িতে গ্যারাজ না থাকায় রাতে রাস্তার উপরেই গাড়ি থাকে। তবে এই নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না।

মধ্য কলকাতায় পাড়াটার অবস্থানের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল। কাছেই ধর্মতলা, অন্য দিকে শিয়ালদহ স্টেশন। কাছেই তিনটি বড় হাসপাতাল। এ অঞ্চলেই রয়েছে কলকাতার অন্যতম প্রাচীন সাধারণ গ্রন্থাগার তালতলা পাবলিক লাইব্রেরি। কাছাকাছির মধ্যে এন্টালি বাজার আর তালতলা বাজার। মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে পাওয়া যায় সব কিছুই। এ পাড়ায় রয়েছে একটি ছোটদের পার্ক। সেখানেও উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। মাঝেমধ্যেই হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলোও।

তবে আগের তুলনায় কমেছে পাড়ার খেলাধুলোর ছবিটা। রাস্তার ধারে কিছু ছেলেকে ক্যারাম খেলতে দেখা যায়। বছরে দু-এক বার পাড়ার রাস্তায় নৈশ ক্রিকেট কিংবা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কমেছে এ পাড়ার আড্ডার ছবিটাও। এখনও কিছু প্রবীণ নিয়মিত আড্ডা দিলেও আড্ডার সেই আকর্ষণটা ফিকে হয়েছে। তেমনই ছুটির দিনে পাড়ার যুব সম্প্রদায়কে বিক্ষিপ্ত ভাবে আড্ডায় যোগ দিতে দেখা যায়।

এ পাড়ার পুজো-পার্বণও কম আকর্ষণীয় নয়। ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হলেও, ১২৫ বছরের পুরনো কালীপুজোর আকর্ষণও কম নয়। এ ছাড়াও এ পাড়ার গাজন উৎসবে বঁটিঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, আগুনঝাঁপ দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। আগে এ পাড়ায় গানের জলসা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়মিত হলেও এখন দু’একটি ছাড়া বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘প্রবীণ সুধীজন সমিতি’-র উদ্যোগে নানা ধরনের সমাজসেবা মূলক কাজ হয়ে থাকে। প্রকাশিত হয় ‘তালতলা দর্পণ’ শীর্ষক সাহিত্য পত্রিকা। আফসোস, এ অঞ্চলে নেই কোনও প্রেক্ষাগৃহ।

পাড়ার রাস্তাটি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত। এক কালে এর নাম ছিল নিয়োগী পুকুর (ইস্ট) লেন। এই রাস্তার উপরেই রয়েছে সুরেন্দ্রনাথের বাড়ি।
শোনা যায়, এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন দুর্গাচরণের বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর তাঁর পায়ে থাকত তালতলার চটি। এখানেই থাকতেন বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট মানুষ। এই পাড়াতেই কেটেছে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাল্যকাল। থাকতেন ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন, ব্যবসায়ী পাঁচুকালী সাহা, সেতার বাদক বে়ঞ্জামিন গোমস, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় নীলমণি মুখোপাধ্যায়, গায়ক বেচু দত্ত প্রমুখ।

এমন একটা পাড়াই আমাকে দিয়েছে মূল্যবোধ, সংস্কার। এখান থেকেই জীবনের উত্তরণের পথে পা বাড়িয়েছি। তাই কখনও এ পাড়া ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। পাঁচ পুরুষের শিকড়ের টান, তাকে উপেক্ষা করা কী সহজ ব্যাপার?

লেখক প্রবীণ চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sankar kumar nath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE