Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অবসর জীবন উপভোগের ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রমও

বয়সের সঙ্গে দৈহিক সৌন্দর্য কী করে ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে এক বার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন জয়পুরের মহারানি গায়ত্রীদেবীকে।

একটি বৃদ্ধাশ্রম। — ফাইল চিত্র

একটি বৃদ্ধাশ্রম। — ফাইল চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০৩
Share: Save:

বয়সের সঙ্গে দৈহিক সৌন্দর্য কী করে ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে এক বার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন জয়পুরের মহারানি গায়ত্রীদেবীকে। উত্তর মিলেছিল— সুন্দরী থাকার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বয়সের সঙ্গে সুন্দর থাকা। বয়সকে মেনে নিয়ে ভাল থাকা। জীবনটাকে উপভোগ করা। যাকে বলে, ‘এজিং উইথ গ্রেস।’

বাঙালি মননে এই বয়সের সঙ্গে সুন্দর থাকার পন্থা এবং ধারণা নিয়ে গত দশ-পনেরো বছরে বিস্তর ভাঙাগড়া চলেছে। একাধারে বাণপ্রস্থ-কাশীবাসের ইতিহাস অন্য দিকে যৌথ পরিবারে বিভিন্ন প্রজন্মের একত্র ঠাঁইয়ের ঐতিহ্যের ভিতরে কোনটাতে বেশি ভাল থাকা যাবে, তা হাতড়ে ফিরেছে বাঙালি।

তার পরে সমাজ-যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে যৌথ পরিবার টুকরো হয়েছে। পারিপার্শ্বিক, পরিস্থিতি, দৃষ্টিভঙ্গী আর চাহিদা বদলেছে। পরবর্তী প্রজন্ম বেশির ভাগই চাকরি বা পড়াশোনার তাগিদে অন্য জায়গায় বসবাস করছে। তারই মধ্যে কখন যেন বৃদ্ধাশ্রম মানেই তিক্ততা, কষ্ট আর আফশোস— এই ধারণা পাল্টে তা ভাল থাকার সোনার কাঠি হয়ে ধরা দিয়েছে শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাঙালি প্রবীণদের একটা বড় অংশের হাতে।

বিশ্বায়ন প্রবীণদের শেখাচ্ছে, ‘লেটস টেক আ স্ট্যান্ড অগেইনস্ট এজইজম।’ চারদিকে আলোচনা হচ্ছে ‘অ্যাক্টিভ এজিং’ বা ‘সক্রিয় বার্ধক্য’ নিয়ে। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে, কাউকে অসুবিধায় না ফেলে, নিজে অসুবিধায় না থেকে আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বয়স্করা বাঁচতে চাইছেন। সেই চাহিদার টানে বৃদ্ধাশ্রম তার পুরনো ধূসর রূপ বদলে যাবতীয় পরিকাঠামো এবং বিনোদন-সমৃদ্ধ আদ্যন্ত ঝাঁ-চকচকে পাঁচতারা হোটেলের রূপ নিয়ে সামনে আসছে।

সাদা চাদর পাতা সার-সার হাসপাতাল মার্কা খাটে শুকনো মুখে, মলিন কাপড়ে বসে থাকা অবসন্ন চেহারাগুলি সেখানে বসে শুধু হা-হুতাশ আর আক্ষেপ করে না। বাড়িতে ছেলে-বৌমার সংসারে জায়গা অকুলান হচ্ছে বলে ছল করে তাঁদের পরিবার থেকে ব্রাত্য করা হয়েছে এমন ইতিহাসও অধিকাংশের নেই। তাঁরা এই সব আধুনিক বৃদ্ধাশ্রমে আসছেন স্বেচ্ছায়, পরিকল্পনা করে। আসছেন বাকি জীবনটা ভাল থাকতে। জীবনটাকে আরও স্বছন্দ ভাবে আকণ্ঠ পান করতে, নিজস্ব পরিমণ্ডলের ‘কমফোর্ট জোন’-এ নির্ঝঞ্ঝাট-নিরাপদ থাকতে। আর সেটা করছেন বলেই প্রিয়জনেদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বরং গাঢ় হচ্ছে।

‘বৃদ্ধাশ্রম’ কথাটাও এখন পুরনো। এর নতুন পরিচিতি ‘কমফোর্ট হোম’, ‘শেল্টার্ড অ্যাকোমোডেশন’ বা ‘রিটায়ার্ড রেসিডেন্সি’ নামে। বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ বা জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, বাণপ্রস্থ বা কাশীবাসের মধ্যে একটা চাপিয়ে দেওয়া ত্যাগের ব্যাপার ছিল। যেন বয়স হয়েছে বলে তাঁকে জীবনের সব চাহিদা বা রসের থেকে নিরাসক্ত হতেই হবে। এটা তো হতে পারে না।

তাঁর ব্যাখ্যায়, লেসেফেয়ার থিওরি যেমন মানুষের সামাজিক চাহিদা, মানসিক চাহিদা, ভালবাসার চাহিদা, যৌন চাহিদার কথা বলে। যেই ৬০ বছর হল অমনি সব চাহিদা জীবন থেকে ম্যাজিকের মতো উবে যাবে, তা তো হয় না। পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে একসঙ্গে থাকলে অনেক ক্ষেত্রে এই চাহিদার জায়গাটায় ঠোকাঠুকি লেগে যায়। তাই পরিবর্তিত মূল্যবোধ ও বাস্তবতা নিয়ে স্বচ্ছ্বল বাঙালি বার্ধক্য এখন বসবাসের জন্য বিলাসবহুল ‘রিটায়ার্ড রেসিডেন্সি’ বেছে নিচ্ছে। এর জন্য ৩ থেকে ২০ ল‌ক্ষ টাকার মতো সিকিওরিটি ডিপোজিট দিতে হচ্ছে। মাসে পরিষেবা অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ লাগছে। পেয়ে যাচ্ছেন জীবনের বিবিধ রস-রং-বিনোদন। বিশেষ করে যাঁদের ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকেন, তাঁরা এই ব্যবস্থায় হাতে চাঁদ পাচ্ছেন।

শ্রীরামপুরের এমন একটি আবাসন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অমিতাভ দে সরকার নিজেও দীর্ঘদিন প্রবীণ মন ও অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। তিনিই জানাচ্ছিলেন, সমাজ ও পরবর্তী প্রজন্মের থেকে প্রবীণদের চাহিদা-র ধরন অনেক বদলে গিয়েছে। অধিকাংশই এখন প্রত্যাশা করেন না যে, ছেলেমেয়ে তাঁদের দেখাশোনা করবে বা খরচ চালাবে। একসঙ্গে থেকে লাঠালাঠি, নিত্য দিন মানসিক যাতনা ভোগের সমস্যার মধ্যে তাঁরা ঢুকতে চান না। বরং এমন একটা জায়গায় স্বাধীন ভাবে থাকতে চান, যেখানে পয়সার বিনিময়ে আরামে থাকতে পারবেন, সব রকম পরিষেবা পাবেন, নিরাপত্তা পাবেন, ইচ্ছে করলে কিছুদিন বাড়িতে প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটিয়ে যেতে পারবেন বা প্রিয়জনেরাও চাইলে কয়েক দিন তাঁদের কাছে গিয়ে কাটাতে পারবেন। অমিতাভবাবুদের প্রকল্পে তো দরকার পড়লে কোনও আবাসিকের মৃত্যুর পরে পারলৌকিক কাজও করে দেওয়া হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার আর এক বিলাসবহুল বার্ধক্য আবাসন নিজেদের বিজ্ঞাপনে যে শব্দগুলি ব্যবহার করছে, সেগুলি হল—কমপ্যানিয়নশিপ, কমফোর্ট, সিকিওরিটি, ফ্রিডম। এখানে যেমন ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরিষেবা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সঙ্গ দেওয়ার লোক, জিম, স্পা, সুইমিং পুল, লাইব্রেরি, ক্লাব রয়েছে তেমনই রয়েছে হুইল চেয়ার বা ওয়াকার নিয়ে হাঁটার আলাদা পথ, বয়স্ক এবং অসুস্থদের উপযোগী বাথরুম, গানের ক্লাস, আঁকার ক্লাস, যোগ ক্লাব, লাফিং ক্লাব, সিনেমা ক্লাব, মন্দির, বাগান। এখানকার এক বাসিন্দাই বললেন, ‘‘সমবয়সীদের সঙ্গে ওয়াইনের গ্লাস হাতে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, জিনসের সঙ্গে গাঢ় কমলা টি শার্ট পরে ক্যারম খেলছি, স্পা নিচ্ছি, বই পড়ছি, মেডিটেশন শিখছি, আবার শনি-রবিবার গাড়ি চালিয়ে ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দেখা করে আসছি। আর কী চাই? একসঙ্গে থাকলে বরং ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিয়ে সমস্যা বাঁধত।’’

এই বদলে যাওয়া বার্ধক্য, ভোল বদলানো বৃদ্ধাশ্রম এবং জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের চাওয়া-পাওয়াগুলি নিয়েই আগামী ২৫ নভেম্বর মুক্তি পেতে চলেছে সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহ-র নতুন ছবি ‘বেঁচে থাকার গান।’ ছবিতে এক জন জেরেন্টোলজিস্টের ভূমিকায় রয়েছেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী, যিনি একটি বিলাসবহুল বার্ধক্য আবাসনে মনোবিদ হিসেবে যোগ দেন। আবাসনের প্রবীণ-প্রবীণাদের আশা-আকাঙ্খাগুলো ধীরে ধীরে প্রাণ পায় সেই মনোবিদের অনুপ্রেরণাতেই। গার্গী বলেন, ‘‘প্রাণ আছে, প্রাণ আছে, প্রাণ থাকলে মান আছে, আর আছে অস্তিত্বের সন্ধান। নিজের অস্তিত্ব মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখতেই অনেক প্রবীণ-প্রবীণা এই আধুনিক পরিকাঠামোযুক্ত বৃদ্ধাশ্রমগুলি বেছে নিচ্ছেন। জীবনটাকে উপভোগ করছেন।’’

মনোবিদ অমিত চক্রবর্তীর ব্যাখ্যাতেও প্রবীণরা যখন দেখছেন পরবর্তী প্রজন্মের লোকেদের সঙ্গে সব সময়ে একত্র থাকার বদলে আলাদা থাকলে দু’পক্ষই ভাল থাকছেন, তখন তাঁরা সেটা বেছে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে বাঁচছেন। কারণ এই থাকায় কোনও বাধ্যবাধকতা, কোনও দায় নেই। বিরামহীন ভাবে যাবতীয় পরিষেবা প্রাপ্তিও নিশ্চিত। বার্ধক্যের বারাণসীর ঠিকানা তাই বদলে যাচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা তাতে কোনও যন্ত্রণা থাকছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Retired life Old age home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE