প্রতীকী ছবি
দরকার একটি দোতলা কিংবা তেতলা বাড়ি। একটি ঝাঁ চকচকে অফিসঘর, সেই ঘরে মাদক সম্পর্কে সচেতনতার প্রচার সংক্রান্ত গুটিকয়েক ইংরেজিতে লেখা পোস্টার কিংবা ছবি —নেশামুক্তি কেন্দ্র খুলতে শুধু এটুকু পরিকাঠামো থাকলেই হল।
আর নেশামুক্তির ‘ব্যবসা’র জন্য প্রয়োজন ইন্টারনেটে নিজের সংস্থার নাম আর ফোন নম্বরটুকু তুলে দেওয়া। সঙ্গে সোসাইটি আইনে বেসরকারি সংস্থার রেজিস্ট্রেশন। তার পরেই নেশামুক্তি কেন্দ্র চালু করে দিতে আর কোনও সমস্যা নেই। এক বার কেন্দ্র চালু হয়ে গেলে মোটামুটি মৌখিক প্রচারেই মাদকাসক্তদের পরিবারের লোকজনের যাওয়া-আসা শুরু হয়ে যাবে। মোটামুটি কেন্দ্রটি কিছু দিন চালাতে পারলে মিলে যেতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারি অনুদানও। কলকাতা শহর এবং শহরতলির বেশ কয়েকটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যাচ্ছে। কিন্তু কোথাওই নেশা ছাড়াতে আসা মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন কথা বলতে পারবেন না চিকিৎসকের সঙ্গে। জানতেও পারবেন না, কী ওষুধ তাঁদের পরিবারের সদস্যটিকে দেওয়া হচ্ছে।
গত সোমবার পর্ণশ্রীর শকুন্তলা পার্কের এক নেশামুক্তি কেন্দ্রের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় রাজু চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির। তাঁর দাদা গোপালবাবুরও অভিযোগ একই। তিনি জানান, তাঁর ভাইকে কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছেন তা তাঁদের কখনও জানানো হয়নি। এক প্রতিবেশীর থেকে জেনে তিনি ওই কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। রাজুকে দু’বার ওই কেন্দ্রেই ভর্তি রাখা হয়েছিল বলে জানান গোপালবাবু। কিন্তু দু’বারই রাজুর চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রেসক্রিপশন তাঁদের দেওয়া হয়নি বলেই দাবি গোপালবাবুর। অর্থাৎ দু’দফায় রাজুর কী চিকিৎসা হয়েছিল তা নিয়ে অন্ধকারে তাঁর পরিবার।
যদিও ওই নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্ণধার রাজীব ঘোষের দাবি, প্রেসক্রিপশন রাজুর পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। তবে রাজীববাবু স্বীকার করেছেন যে তাঁর কেন্দ্রে স্বাস্থ্য দফতর থেকে নেওয়া মেন্টাল হেল্থ লাইসেন্স নেই।
একই রকম অভিজ্ঞতা স্বরূপা রায় (নাম পরিবর্তিত) নামে এক মাদকাসক্তের পরিবারেরও। অনলাইনে হদিস পেয়ে স্বরূপাদেবীকে গড়িয়ার কন্দরপুরের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁর পরিবারেরও অভিযোগ, গত এক মাসে সেখানে তাঁরা কোনও চিকিৎসকের দেখা পাননি। এমনকি, কী চিকিৎসা তাঁর চলছে সে সম্বন্ধেও তাঁদের কিছু জানানো হচ্ছে না।
নেশাগ্রস্ত মানুষকে সুস্থ করে তোলার উদ্দেশ্যে রয়েছে কলকাতা পুলিশের শুদ্ধি প্রকল্প। সেটির সঙ্গে জড়িত একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্ণধার রামাদ্রি সেনগুপ্ত জানান, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও মাদকাসক্ত ব্যক্তির আত্মীয়দের সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেন মনোবিদেরা। রামাদ্রিবাবু জানান, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত নজরে রাখতেও হয়। যাতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি কোনও দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারেন। ফলে প্রশ্ন ওঠে, যে নেশামুক্তি কেন্দ্রে রাজু চৌধুরী ছিলেন সেখানে তাঁর উপরে উপযুক্ত নজরদারি কি রাখা হয়েছিল?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মেন্টাল হেল্থ লাইসেন্স পাওয়ার বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মাদকাসক্তকে নজরদারির মধ্যে রাখা। এবং এই ধরনের কেন্দ্র চালাতে হলে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা, দু’টোই জরুরি। এমনটাই বলছে নিয়ম। কিন্তু বাস্তবে বহু কেন্দ্র জানিয়েছে যে মেন্টাল হেল্থ সার্টিফিকেটের বিষয়টি রা জানেই না।
তা সত্ত্বেও রমরমিয়ে শহর ও শহরতলিতে গজিয়ে উঠছে এমন কেন্দ্র। যেগুলির ভিতরে চিকিৎসার নামে আদৌ কী চলে তা জানতেই পারে না রোগীর পরিবার। শুধু নিয়ম করে তারা পরিবারের প্রিয় মানুষটিকে সুস্থ করতে মোটা টাকা খরচ করছেন। কিন্তু কে চালাবে এ সবের উপরে নজরদারি?
রাজ্যের সমাজ কল্যাণ দফতরও এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে। আধিকারিকদের একাংশের দাবি, নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলির উপরে নজরদারি কার করার কথা তা তাঁরাও জানেন না। আবার একাংশের দাবি, নজরদারি চালানোর কথা সমাজকল্যাণ দফতরেরই। যদিও দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘এই বিষয়টি আমাদের দেখার কথা নয়। তবে প্রচুর অভিযোগ আসছে। লোকসভা ভোটের পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’’
যদিও এমন প্রতিশ্রুতি আগেও অনেক দেওয়া হয়েছে। নেশামুক্তি কেন্দ্রের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে রাজু চৌধুরীর মৃত্যুর পরে তাই প্রশাসন কোনও শিক্ষা নেবে কি না, সেটাই এখন দেখার। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy