ঠিক যেন একান্নবর্তী পরিবার। যেখানে আজও আছে সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থাকার অভ্যাস। তাই হারায়নি মানুষে মানুষে আন্তরিক সুসম্পর্ক। কর্মব্যস্ত জীবনের অজুহাতে বা ব্যস্ততার ছুতোয় কাউকে অবহেলা নয়, উপেক্ষা নয়, বরং সকলকে নিয়ে মিলেমিশে থাকাই আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়াটার ঐতিহ্য। আজকের দিনে বড় প্রাপ্তি বৈকী!
টালিগঞ্জের নরেন্দ্রনাথ ঘোষ লেন যা এন এন ঘোষ লেন নামে পরিচিত, সেটাই আমার পাড়া। বাইরের চেহারাটা সাধারণ হলেও বর্ণময় চরিত্রে কিংবা নানা গুণে তা মোটেই সাধারণ নয়। সত্যি বলতে কি যে কোনও পাড়ায় প্রাণসঞ্চার করেন তার বাসিন্দারা। পাড়াটা সুন্দর হয়ে ওঠে কিছু মানুষের উপস্থিতি, ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব, আর তাঁদের কর্মকাণ্ডের জন্য। এ পাড়াও তার ব্যতিক্রম নয়।
এন এন ঘোষ লেন গিয়ে মিশেছে মহানায়ক উত্তমকুমার সরণিতে। অন্য দিকে, চণ্ডীতলা। কাছেই বাবুরাম ঘোষ রোড আর এম এন সেন লেন।
এ পাড়ায় মূলত দেশভাগের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতায় ভিটেমাটি হারা মানুষের বসবাস। তাই প্রথম থেকেই মানুষে মানুষে রয়েছে আত্মিক টান আর ঐক্য। আমার জন্ম পূর্ব বাংলার কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবেড়িয়ায়। সেই ১৯৬০ থেকে এ পাড়ায় বসবাস। তখন পাড়াটা ছিল অনেক ফাঁকা, বাড়ির সংখ্যাও ছিল কম। এখন যেখানে জাপান কনসালের অফিসটি, আগে সেখানেই ছিল একটি ডোবা। তখন রাতে শেয়াল ডাকত। সন্ধ্যার পরে কম পাওয়ারের ডুমের মৃদু আলোয় বা লোডশেডিং-এর জমাট আঁধারে ডানা মেলত জোনাকি। পাড়াটা তখন হাজার হাজার জোনাকির আলোয় রূপকথার জগৎ হয়ে উঠত। তখন মনে পড়ে যেত আমাদের গ্রামের কথা।
সময়ের সঙ্গে পাড়াটার উন্নতি হয়েছে। আগে মশার উপদ্রব থাকলেও এখন সেটা অনেকটাই কমেছে। নিয়ম করে রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ, মশার তেল ও ব্লিচিং ছড়ানো হয়। রয়েছে পর্যাপ্ত জল, জোরালো আলোর ব্যবস্থাও। এলাকার কাউন্সিলর মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নয়নে উদ্যোগী। কাছেই একটি বড় বস্তি ছিল। সেখানে পুর-উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বস্তিবাসীদের জন্য আবাসন। এখনও পাড়ার কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয় সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠান।
৮৫ বছরের পুরনো এ পাড়ার সর্বজনীন দুর্গোৎসবটি ‘দীনজনের মাতৃপূজা’ নামেই পরিচিত। পাড়ার সকলের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান একে প্রাণবন্ত করে তোলে। তবে সময়ের সঙ্গে হারিয়েছে এ পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক আর গানের জলসার রেওয়াজ।
আমাদের পাড়াটা টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ার গা ঘেঁষা। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও, টেকনিশিয়ানস স্টুডিও কাছাকাছির মধ্যেই। সেই সূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছি বহু বিশিষ্ট অভিনেতাকে। চিকিৎসক হিসেবেই যাতায়াত ছিল কানন দেবীর বাড়িতে। এক বার গভীর রাতে তাঁর শ্বাসকষ্ট হওয়ায় তাঁর বাড়ি যেতে হয়েছিল। তিনি সুস্থ বোধ করার পরে আমায় অনুরোধ করেছিলেন অত রাতে আর বাড়ি না ফিরতে। তারই অনুরোধে সারা রাত বসে গল্প করেছিলাম। আর এক বার টেকনিশিয়ান স্টুডিওর কোনও কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমায় যেতে হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে যিনি আমার ভিজিটটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি উত্তমকুমার। এমনটা বেশ কয়েক বার হয়েছিল। সেখানেই একবার দেখেছিলাম সুচিত্রা সেনকে।
ছবি-সুদীপ্ত ভৌমিক
কমেছে এ পাড়ার খেলাধুলোর পরিবেশ। তবে এখনও ছোটরা গলিতে ক্রিকেট খেলে। আগে শীতকালে রাস্তায় ব্যাডমিন্টন খেলা হত। এখন কর্পোরেশন স্কুলের সামনে কিছু ছেলে ক্যারাম খেলে। তবে কমেছে ফুটবল খেলার ঝোঁকটা। কাছের মাঠটাও অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে তপন সিংহ মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
এ পাড়ার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক, যে কোনও প্রয়োজনে পাড়ার যুব সম্প্রদায়কে পাশে পাওয়া যায়। তাই লোকবলের অভাবে কাউকে অসহায় বোধ করতে হয় না। কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা রক্তের প্রয়োজনে এক ডাকেই তাঁরা হাজির হয়। কর্মসূত্রে আমি তখন মালদায় আর আমার স্ত্রী গবেষণা সূত্রে এডিনবরায়। আমার মা ও ছোট মেয়ে তখন কার্যত পাড়া-পড়শির ভরসায় এখানেই ছিলেন। কিন্তু কখনও কিছুর অভাব বোধ হয়নি পাড়াপড়শির আন্তরিকতা ও সহযোগিতায়।
সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়েছে এ পাড়ার আড্ডার পরিবেশ। বাড়ির পাশেই একটি রকে বসত জমাটি আড্ডা। এখন আড্ডা বসে নানুবাবুর বাজারে একটি চায়ের দোকানে। তবে আমাদের তাসের আড্ডাটা হারায়নি। প্রতি রবিবার পাড়ার এক এক বন্ধুর বাড়িতে সেটা বসে।
কিছু সমস্যাও আছে পাড়াটায়। রাস্তাটা খুব একটা চওড়া না হওয়ায় যানজট সমস্যা ভোর থেকে বিব্রত করে তোলে। বেশ কিছু জায়গায় পাশাপাশি দু’টি গাড়ি যেতে পারে না। অটো, রিকশা, গাড়ি মিলে এমন যানজট হয় যে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে বেরোতে সমস্যা হয়। তবে সকালের যানজটটুকু ছাড়া পাড়াটা শান্তিপূর্ণ। আছে কিছু আক্ষেপও। কাছেই নানুবাবুর বাজারটা আর আগের মতো জমজমাট নেই। কমেছে বিক্রেতাদের সংখ্যাও। তাই এখন ভরসা করুণাময়ী বাজার।
এক সময় এ পাড়ায় থাকতেন বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ। যেমন অধ্যাপক হীরালাল চক্রবর্তী, চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। এখন এম এন সেন লেনে থাকেন সন্ধ্যা রায়। ভাবতে ভাল লাগছে এখনও এ পাড়ায় থাবা বসায়নি ফ্ল্যাট সংস্কৃতি। এখনও সব ক’টিই বাড়ি।
বিশেষ এক আকর্ষণে সারাটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিলাম। সেটা হল সম্পর্কের উষ্ণতা আর মূল্যবোধ। সেটা এতটুকুও ফিকে হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy