Advertisement
১৭ মে ২০২৪

পরিবারটা আচমকা ছোট করে দিয়েছে উড়ালপুল, সুখী ফ্ল্যাট এখন খাঁ খাঁ

মধ্য কলকাতার গলি, তস্য গলি পেরিয়ে পৌঁছতে হয় বাড়িটায়। নিমতলা ঘাট স্ট্রিট থেকে বৈষ্ণব শেঠ ফার্স্ট লেনে পড়তেই দু’পাশ থেকে আগোছালো ঘর-গেরস্থালি আরও চেপে ধরে রাস্তাটাকে। ডান দিকে বাঁক নিয়ে একটু হাঁটলেই বাজার।

মৃত সরিতা ও অজয় কন্দোই। —নিজস্ব চিত্র।

মৃত সরিতা ও অজয় কন্দোই। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ১৯:২৯
Share: Save:

মধ্য কলকাতার গলি, তস্য গলি পেরিয়ে পৌঁছতে হয় বাড়িটায়। নিমতলা ঘাট স্ট্রিট থেকে বৈষ্ণব শেঠ ফার্স্ট লেনে পড়তেই দু’পাশ থেকে আগোছালো ঘর-গেরস্থালি আরও চেপে ধরে রাস্তাটাকে। ডান দিকে বাঁক নিয়ে একটু হাঁটলেই বাজার। সেখান থেকে বাঁয়ে ঘুরলেই প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিট। অবাঙালি মহল্লা এবং এলাকার প্রায় সব বড় বাড়িই দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাড়-পাঁজর বার করা চেহারা বাড়িগুলোর। বাঁ হাতে মল্লিকদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা ছাড়িয়েই টেগোর ক্যাসেল। ২৬ নম্বর প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিটের এই বহু বহু পুরনো হাউজিং কমপ্লেক্স যতই হতশ্রী দশায় থাকুক, তার মধ্যে কন্দোই পরিবারের ফ্ল্যাটটার অন্দরমহল কিন্তু বেশ গোছানোই ছিল। স্বাচ্ছ্ল্য আর স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু শুক্রবার সেই সুখী গৃহকোণে পা রাখতেই মনে হল, সব কেমন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে।

বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার আগে পর্যন্তও এই সুখী গৃহকোণের কর্তা ছিলেন বছর ৪৮-এর অজয় কন্দোই। আর কর্ত্রী ছিলেন সরিতা কন্দোই। মধ্য কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি শ্যালককে দেখতে যাওয়ার জন্য স্ত্রী সরিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন অজয়। টানা রিক্সায় চেপে যাচ্ছিলেন হাসপাতালের দিকে। সাড়ে ১২টা নাগাদ গণেশ টকিজ মোড়ে পৌঁছয় রিক্সাটা। অজয়-সরিতার যাত্রা সেখানেই থেমে গিয়েছে চিরতরে। মাথার উপর থেকে আচমকা ধসে পড়া উড়ালপুল, রিক্সা, রিক্সাচালক এবং দুই যাত্রীকে পিষে দিয়েছে গণেশ টকিজের মোড়েই। শুক্রবার টেগোর ক্যাসলের অন্ধকার সিড়ি বেয়ে তিন তলায় পৌঁছনোর পর সরু, ঘুপচি করিডর ধরে ডান দিকে দশ-বারো পা এগিয়েই থামতে হল। ফ্ল্যাটের দরজা হাট খোলা। দরজার সামনে কয়েক ডজন জুতো-চটি। দরজা দিয়ে ভিতরে পা রাখলেই ড্রয়িং রুম। অর্ধেকটা জুড়ে বিছিয়ে রাখা হয়েছে সাদা চাদর। অশীতিপর জগদীশ প্রসাদ কন্দোই দুই সদ্য যুবক নাতিকে দু’পাশে নিয়ে বসে রয়েছেন। তিন জনেই বিহ্বল, হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাঁদের ঘিরে বসে রয়েছেন পরিজন ও প্রতিবেশীরা। ড্রয়িং রুমের প্রান্তে রান্নাঘরটা খাঁ খাঁ করছে এক রাশ শূন্যতা নিয়ে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে কেউ আর ঢোকেনি সেখানে। কাঠগোলা থেকে ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন অজয়। সরিতা তার আগেই রান্নাবান্না সেরে ফেলেছিলেন। প্রবীণ শ্বশুর-শাশুড়িকে দুপুরের খাবার বেড়ে দিয়ে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন সরিতা। দুই ছেলেকে বলে যান খিদে পেলে খেয়ে নিতে। অজয়-সরিতা ঠিক করেছিলেন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া করবেন। অভিষেক, নিখিল বাবা-মার দেরি দেখে খেয়ে নেয়। তার পরই উড়ালপুল ভাঙার খবর আসে। বাবা-মাকে ঘটনাটা জানানোর জন্য ফোন করেছিল বড় ছেলে অভিষেক। অজয় বা সরিতা ফোন ধরেননি। বার বার ফোন করা সত্ত্বেও যোগাযোগ না হওয়ায় টেনশন বাড়তে শুরু করে। বিকেলে জানা যায়, মারওয়াড়ি হাসপাতালে রয়েছে দু’জনের দেহ।

আরও পড়ুন:

উড়ালপুলের সাবকন্ট্রাক্ট শাসক নেতার ভাইপোকে! জড়াচ্ছে তৃণমূলের নাম

বৃহস্পতিবার রাতে অজয়-সরিতার দেহ নিয়ে শববাহী গাড়ি যখন টেগোর ক্যাসেল চত্বর থেকে রওনা দেয় নিমতলা শ্মশানের দিকে, তখনই ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন বিমলা দেবী। ডান দিকের কোনার সেই ঘরটা থেকে শুক্রবার দুপুরেও ভেসে আসাছে মৃদু গোঙানির শব্দ। খাটের প্রান্তে বসে একটানা কেঁদে চলেছেন অজয়ের মা বিমলা। হাউজিং-এর অন্য মহিলারা পালা করে তাঁর সঙ্গে থাকছেন সারা ক্ষণ। কিন্তু বিমলা দেবী এখন নির্বাক। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। কোনও সান্ত্বনাবাক্য কান পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না, আশপাশে ঘটে চলা কোনও কিছুই তাঁকে আর স্পর্শ করছে না।

অভিষেক, নিখিল এখনও পড়ুয়া। বাবা অজয় একাই সামলে নিতেন ব্যবসার কাজ। পড়ুয়া ছেলেদের কখনও ব্যবসায়িক ঝক্কির অংশীদার হতে দেননি। পরিবারের এক মাত্র আয়ের উৎস অজয় কন্দোইয়ের কাঠগোলা এখন কে সামলাবেন? অশক্ত জগদীশ-বিমলার দেখভাল কী করে হবে? অভিষেক, নিখিল পড়াশোনাই বা শেষ করবে কী করে? টেগোর ক্যাসলের তিনতলার ফ্ল্যাটটার হাটখোলা দরজা দিয়ে এমন এক রাশ প্রশ্ন এখন হানা দিয়েছে। কিন্তু উত্তর কোথাও নেই। তিন কামরার গৃহস্থালিতে এখন শুধুই শূন্যতা। দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনির মতো ভাসছে প্রশ্নগুলো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flyover Collapse Ajay Kandoi Sarita Kandoi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE