Advertisement
২১ মে ২০২৪
Gita Path at Brigade

‘লক্ষ’পূরণের তর্ক নিয়েও নতুন রঙের ব্রিগেড দেখল কলকাতা, গীতাপাঠ শেষে ময়দানে মিশল রাজনীতিও

ব্রিগেডে লক্ষ মানুষ একসঙ্গে গীতা পাঠ করবেন। এমনটাই দাবি করেছিলেন আয়োজকরা। সেই লক্ষ্য সফল হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। তবে আয়োজকরা খুশি। তাঁদের কথায়, ব্রিগেডে লক্ষ্যপূরণও হয়েছে।

রবিবারের ব্রিগেড ময়দান।

রবিবারের ব্রিগেড ময়দান। — নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৭
Share: Save:

একের পিঠে পাঁচটা শূন্য বসালে লক্ষ হয়। তবে অভিধানে ‘লক্ষ’ শব্দের আরও একটি অর্থ ‘অসংখ্য’ বলা রয়েছে। ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’ কর্মসূচির আয়োজকরা সেটাই বলতে পারতেন। কারণ, অসংখ্যের সঙ্গে কিছু যোগ বা বিয়োগ করলে সংখ্যাটা অসংখ্যই থেকে যায়। কিন্তু দাবি করা হয়েছে রবিবার ব্রিগেড ময়দানে ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ সমবেত কণ্ঠে গীতাপাঠ করেছেন। তাতে বিশ্বরেকর্ড হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে সে সব বাদ দিলে রবিবার আসলে এই প্রথম বার অন্য এক ব্রিগেড দেখল কলকাতায়। যেখানে রাজনৈতিক স্লোগান নেই, মঞ্চে প্রায় সকলেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী।

বাংলায় বরাবর রাজনৈতিক শক্তিপ্রদর্শনের ভূমি হয়েছে ব্রিগেড। এই ময়দানেই ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন প্রধান নিকোলাই বুলগানিন ও রুশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভকে সংবর্ধনা দেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। আবার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গঠনের পরে ইন্দিরা গান্ধী ও মুজিব রহমানের সমাবেশও ব্রিগেডে ইতিহাস তৈরি করে। তার আগে ১৯৬৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গড়ে ব্রিগেডে বিজয় উৎসব পালন করে যুক্তফ্রন্ট। আবার বাম জমানার শেষে ২০১১ সালে ব্রিগেডেই তৃণমূলের শহিদ দিবসের সমাবেশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রবিবারের জমায়েতের একাংশ।

রবিবারের জমায়েতের একাংশ। — নিজস্ব চিত্র।

ইতিহাস আরও রয়েছে। এই ময়দানেই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বক্তৃতা করেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। আবার ১৯৮৮ সালে ব্রিগেডে নতুন ইতিহাস তৈরি করে একই মঞ্চে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ, জ্যোতি বসু, অটলবিহারী বাজপেয়ী হাতে হাত ধরে ছিলেন। এর সবক’টিতেই ছিল রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি। সে সবের থেকে একেবারে আলাদা রবিবারের গীতাপাঠের ব্রিগেড। যেখানে স্লোগানের বদলে মন্ত্র-স্তোত্র, ধূপধুনোর গন্ধ। ঢাক, কাঁসর, শঙ্খ, উলুধ্বনিতে পুজোর আবহ।

রবিবার ব্রিগেডে তিনটি বিশ্বরেকর্ড গড়ার দাবি আয়োজকদের।

রবিবার ব্রিগেডে তিনটি বিশ্বরেকর্ড গড়ার দাবি আয়োজকদের। — নিজস্ব চিত্র।

এমন এক সমাবেশে কথা দিয়েও কথা না রেখে অন্য ব্রিগেড তৈরিতে যেন সাহায্যই করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আয়োজকদের অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী না আসায় এক দিক থেকে ভালই হয়েছে। প্রথমে যখন এই কর্মসূচির পরিকল্পনা হয় তখন অবশ্য কোনও বিশিষ্টের উপস্থিতির কথা ভাবা হয়নি। পরে ঠিক হয় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু আসবেন। তারও পরে আসে মোদীর নাম। সম্মতি মিলতে তা নিয়ে প্রচার হলেও প্রায় শেষ বেলায় সফর বাতিলের কথা জানায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। রবিবার ব্রিগেডে হাজির থাকা সন্ন্যাসী সত্যানন্দ ব্রহ্মচারীর মুখে শোনা গেল মোদী না থাকায় ‘শাপে বর’ প্রবাদ। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল হয়ে শাপে বর হয়েছে। সবই ভগবানের ইচ্ছায়। এই যে এত মানুষ গীতার টানে এসেছেন সেটাকে বলা হত মোদীর টান। সভায় ‘মোদী মোদী’ স্লোগানও উঠতে পারত। তার বদলে শুধুই ভক্তির পরিবেশ। ভগবানের নামই স্লোগান হয়েছে। ইতিহাস এটাকে ‘মোদীর ব্রিগড’ নয়, ‘গীতার ব্রিগেড’ বলবে। এই ময়দান তো আজ ধর্মক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র।’’ প্রসঙ্গত, রবিবারের ব্রিগেডে শোনা গেল নতুন স্লোগান ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, গীতাপাঠ ঘরে ঘরে’।

ব্রিগেডে গীতাপাঠে মগ্ন বিজেপি বিধায়ক চন্দনা বাউড়ি।

ব্রিগেডে গীতাপাঠে মগ্ন বিজেপি বিধায়ক চন্দনা বাউড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

তবে ভক্তির ব্রিগেড সঙ্গমে মিশেছে রাজনীতিও। তবে মঞ্চের নীচে। বিজেপির প্রায় সব সাংসদ, বিধায়ক, রাজ্য নেতানেত্রীরাই উপস্থিত ছিলেন। গীতাপাঠে অংশও নিয়েছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ থেকে আরএসএস-এর প্রথম সারির রাজ্য নেতাদেরও দেখা গিয়েছে পাঠের আসনে। আড়ালে গোটা গেরুয়া শিবির থাকলেও আয়োজকদের দাবি ছিল রাজ্যের সাড়ে তিন হাজারের বেশি ধর্মীয় সংগঠন যুক্ত হয়। জমায়েতের বড় অংশই ছিল সেই সব সংগঠনের ভক্তেরা। তার সঙ্গেই মিশে ছিলেন বিভিন্ন জেলা থেকা আসা বিজেপি কর্মী, সমর্থকেরা। ঘোষিত সূচি অনুযায়ী প্রথমে দ্বারকামঠের শঙ্করাচার্য সদানন্দ সরস্বতীকে নিয়ে শোভাযাত্রা, নজরুলগীতি ‘হে পার্থসারথি’, সমবেত শঙ্খবাদন ইত্যাদি হয়ে যায়। এর পরে গীতার চারটি অধ্যায় পাঠ হয়।

মূল অনুষ্ঠানের শেষ এখানেই। তবে এর পরে মঞ্চে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনলেন ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’ আয়োজনের সভাপতি স্বামী প্রদীপ্তানন্দ। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসীর মুখে সরাসরি এল রাজ্য সরকারকে আক্রমণ। বললেন, ‘‘আমরা অনেক আর্জি জানিয়েছিলাম এই কর্মসূচির দিন যাতে টেট না হয়। কিন্তু আমাদের আর্জি শোনা হয়নি।’’ টেটের দিন পিছিয়ে এই রবিবারে ফেলার পিছনে রাজনীতি রয়েছে বলেও দাবি করেন প্রদীপ্তানন্দ। তাঁর বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে এল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামও। অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখিয়ে সমাজের অসুরদের নাশ করারও ডাক দিলেন তিনি। সেই সঙ্গে বললেন, ‘‘সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা না থাকলে পদ্মফুলও ফুটবে না, ঘাসফুলও ফুটবে না, কাস্তে হাতুড়িও থাকবে না।’’

তবে অনুষ্ঠানের নামেই যে হেতু সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে আর ব্রিগেড মানেই যেখানে মাথা গোনার রীতি সেখানে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খেয়ে গেল রবিবারের সমাবেশে। কত লোক হয়েছে? নানা সংখ্যা শোনালেন নানা জন। সে সবের থেকে অনেক বেশির ঘোষণা মঞ্চ থেকে। আর এ নিয়ে প্রশ্নে এই কর্মসূচির এক সংগঠক বললেন, ‘‘আমরা চেয়েছিলাম সন্ন্যাসীদের নিত্যকর্ম আর মৃতদেহের বুক থেকে গীতাকে নামিয়ে সাধারণের হাতে দেওয়ার। সে লক্ষ্য সার্থক।’’ সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এতেই ‘লক্ষ’পূরণ দেখছেন গেরুয়া শিবিরের অনেকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE