শহরের মধ্যে থেকেও কার্যত দুষ্কৃতীদের ‘মুক্তাঞ্চল’! কখনও ভরসন্ধ্যায় যুবককে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে খুন করা হচ্ছে, কখনও আবার দুই গোষ্ঠীর বিবাদে প্রকাশ্যেই হচ্ছে বোমা-গুলির বৃষ্টি। কখনও আবার ভিন্ রাজ্যের পুলিশ এসে ওই এলাকায় হানা দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে মাসের পর মাস ঘাঁটি গেড়ে থাকা এক দল বাংলাদেশিকে। শহরের বাকি অংশে অপরাধের লেখচিত্র ওঠানামা করলেও আনন্দপুরের গুলশন কলোনি আছে গুলশন কলোনিতেই।
গত কয়েক বছরে অপরাধমূলক একাধিক ঘটনায় উঠে এসেছে ই এম বাইপাস সংলগ্ন গুলশন কলোনির নাম। সম্প্রতি কসবায় পুরপ্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর চেষ্টার ঘটনাতেও পুলিশি তদন্তে সামনে এসেছে গুলশন কলোনির সিন্ডিকেট-বিবাদ। তার জেরেই পুরপ্রতিনিধির উপরে হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
শহরে একের পর এক অপরাধের ঘটনায় বার বার গুলশন কলোনির নাম জড়ানোর বিষয়টি লালবাজারের কর্তাদের নজর এড়ায়নি। সপ্তাহ দুয়েক আগে লালবাজারের অপরাধ দমন সংক্রান্ত বৈঠকে কর্তাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল আনন্দপুর থানার এক দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে। সেই বৈঠকে রীতিমতো দাঁড় করিয়ে ওই আধিকারিককে প্রশ্ন করেন পুলিশকর্তারা। কেন ওই এলাকায় অপরাধে লাগাম পরানো যাচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলে আধিকারিককে ভর্ৎসনা করা হয়। শুধু আনন্দপুর থানার আধিকারিক নন, লালবাজারের গুন্ডা দমন শাখাকেও গুলশন কলোনি নিয়ে প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছিল বলে খবর। বৈঠকে উপস্থিত পুলিশকর্তারা গুলশন কলোনিতে অপরাধ কমাতে দ্রুত পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘন জনবসতি এবং ঘিঞ্জি ওই এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য নিয়ে লালবাজারের উদ্বেগ অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিক বার সে কথা শোনা গিয়েছে পুলিশকর্তাদের বৈঠকে। যদিও তার পরেও পরিস্থিতির বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। ফলে, লালবাজারের এই নির্দেশের পরেও গুলশন কলোনিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আনন্দপুর থানা থেকে গুলশন কলোনির দূরত্ব মেরেকেটে পাঁচ কিলোমিটার। কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত গুলশন কলোনি এবং সংলগ্ন মার্টিনপাড়ায় লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করলেও ভোটারের সংখ্যা মেরেকেটে দুই থেকে তিন হাজার। মূলত অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা লোকজনই ওই সমস্ত এলাকায় এসে ভিড় করছেন। যাঁদের অধিকাংশই আদতে ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা বলে খবর। সেখানে কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকা ঘিরে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ গড়ে উঠছে বলে অভিযোগ। আর এই সমস্ত বেআইনি নির্মাণ ঘিরে গজিয়ে ওঠা একের পর এক সিন্ডিকেটের বিবাদই বিভিন্ন অপরাধের মূল কারণ বলে স্থানীয়দের দাবি। সিন্ডিকেটগুলির পিছনে রাজনৈতিক নেতাদের মদত থাকায় তাদের দৌরাত্ম্য দিন দিন লাগামছাড়া হয়ে উঠছে বলেও অভিযোগ। স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘বেআইনি নির্মাণ ঘিরে লক্ষ লক্ষ টাকা উড়ছে ছোট্ট এই জায়গায়। কেউ কোনও বৈধ কাগজপত্র রাখার বা নিয়ম-নীতি মানার তোয়াক্কা করেন না। ইচ্ছে মতো লোকজন বসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, কাদের জমিতে কারা বাড়ি করছেন, কারা সেখানে থাকছেন, কিছুই জানা যায় না।’’ তাই বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করা না গেলে আদৌ গুলশন কলোনিতে অপরাধ কমানো যাবে কিনা, তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় থাকছেই।
লালবাজারের এক কর্তা যদিও বলছেন, ‘‘ওই এলাকার অপরাধের নানা ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে অপরাধ আটকাতে যা যা করার, তা-ই করা হচ্ছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)