দু’-দু’টো বছর পার হয়ে গেলেও সন্তানহারা বাবার আবেদনে দৃকপাত করেনি রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। বিন্দুমাত্র এগোয়নি তাদের তদন্ত। অথচ যে স্বাস্থ্য দফতরের বিরুদ্ধে দীর্ঘসূত্রতার অনেক অভিযোগ, তারাই সেই বৃদ্ধের আবেদন পাওয়ামাত্র সারা দিয়েছে। লিখিত অভিযোগ হাতে আসার তিন দিনের মধ্যে ছ’সদস্যের কমিটি গড়ে তদন্ত শুরু করেছে। সাত মাসে তদন্ত শেষ করে ওই কমিটি গুরুতর চিকিৎসা গাফিলতির রিপোর্ট দিয়েছে দমদমের এক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে।
শুধু তা-ই নয়, গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছে সেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দ্রুত তদন্তের কাজ শেষ করার অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কাজ কতটা এগোচ্ছে, সে ব্যাপারে তথ্য চেয়েও পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে তারা রিপোর্টের প্রতিলিপি পাঠিয়ে দিয়েছে দিল্লিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি অমিত বিশ্বাসের কাছে। যাতে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রক ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)-কে এই ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে চাপ দেয়।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের মেডিক্যাল কাউন্সিলগুলির বিরুদ্ধে বছরের পর বছর চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগগুলি নিষ্পত্তির নামে ফেলে রাখার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এ ক্ষেত্রে সুবিচারের আশায় হত্যে দিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না অভিযোগকারীদের। সে দিক থেকে উত্তর কলকাতার নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ সরকার নামে এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করে মেডিক্যাল কাউন্সিলের উপরে চাপ তৈরির যে পথ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর নিয়েছে, তাতে রোগীর অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতেরা উচ্ছ্বসিত। তাঁদের মতে, যেহেতু নিরপেক্ষ সরকারি তদন্তের আলাদা মূল্য রয়েছে, তাই অদূর ভবিষ্যতে মেডিক্যাল কাউন্সিল হোক বা সর্বোচ্চ আদালত বা ক্রেতা সুরক্ষা আদালত— সর্বত্র এই রিপোর্ট অভিযোগকারীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে।
ইন্দ্রজিৎ সরকারের ঘটনায় স্বাস্থ্য দফতর গঠিত তদন্ত কমিটিতে ছিলেন ডেপুটি ডিরেক্টর (প্রশাসন) হরেকৃষ্ণ চন্দ, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের দুই চিকিৎসক অলোক চৌধুরী, ধ্রুবজ্যোতি ভৌমিক, বাঙুর হাসপাতালের চিকিৎসক তপন মণ্ডল ও জয়দীপ রায় এবং স্বাস্থ্য দফতরের ডেপুটি অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর (প্রশাসন) সুব্রত রায়। ওই কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, কোনও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে সরকার নিজেই তার তদন্ত করে ও দোষ প্রমাণিত হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সমস্যা হয় বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে। সেখানে পরিকাঠামোগত ত্রুটি থাকলে স্বাস্থ্য দফতর ‘ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী শুধু তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। সেখানে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা বা দোষ প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়ার অধিকার স্বাস্থ্য দফতরের নেই। সেটা একমাত্র করতে পারবে মেডিক্যাল কাউন্সিল।
কাউন্সিলে অভিযোগের সুরাহা হতে প্রচুর সময় লাগে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়েও অনেক সময়ে প্রশ্ন ওঠে। কাউন্সিলের তদন্তের পথ সুগম করতে অনেক রোগীপক্ষই এখন স্বাস্থ্য দফতরের দ্বারস্থ হয়ে আলাদা তদন্ত চাইছেন এবং সেই তদন্তে চিকিৎসকদের গাফিলতি পাওয়া গেলে রিপোর্ট দেখিয়ে মেডিক্যাল কাউন্সিলের তদন্তে গতি আনতে চাইছেন। স্বাস্থ্য দফতর যেহেতু বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসায় গাফিলতির ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে না, তাই তারাও নিজস্ব তদন্ত চালিয়ে পরোক্ষ ভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উপরে চাপ দিতে চাইছে। যেমন ইন্দ্রজিৎ সরকারের ঘটনায় হয়েছে।
২০১৪ সালের ১০ জুলাই বাড়ির সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যান বছর পঁয়ত্রিশের ইন্দ্রজিৎ। তাঁকে দমদমের এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দু’দিন পরে সেখানে মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর বাবা রঞ্জিত সরকারের অভিযোগ, পড়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর ছেলের পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র তাঁর মেরুদণ্ডের চোটের চিকিৎসা করেন। ফলে তলপেটের ভিতরে রক্তপাতে মারা যান ইন্দ্রজিৎ। ২০১৪-এর অগস্টে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে অভিযোগ করার পরে দশ মাস কেটে গেলেও যখন তদন্ত একচুল এগোয় না, তখন তিনি স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ জানান। অভিযোগ পেয়েই ২০১৫-র ৩ জুলাই স্বাস্থ্য দফতরের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে। ২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে তারা রিপোর্ট দেয়। যাতে বলা হয়, চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতরের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাসপাতালের সার্জনরা ক্লিনিক্যাল নোটে তলপেটের বাঁ দিকে গভীর আঘাতের কথা জানিয়েছিলেন। তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই রিপোর্টে গুরুতর সমস্যা মিলেছিল। তা সত্ত্বেও সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হয়নি। ২০১৪ সালের ১১ জুলাইয়ের যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল যে, তলপেটে রক্তক্ষরণ (লেফ্ট অ্যাড্রিন্যাল হেমারেজ) হচ্ছে। তার পরেও ১২ জুলাই দ্বিতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত চিকিৎসকেরা ব্যবস্থা নেননি। ততক্ষণে এত দেরি হয়ে গিয়েছে যে, মৃত্যু এড়ানো যায়নি। রিপোর্ট বলছে, পড়ে গিয়ে চোট পাওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল পুলিশেকে জানায়নি এবং মৃত্যুর পরে দেহের ময়না-তদন্ত করেনি। এটি মেডিকোলিগাল দিক দিয়ে চূড়ান্ত গাফিলতি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, তারা এখনই কোনও মন্তব্য করতে চান না।
স্বাস্থ্য দফতর যদি এত দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারে, তা হলে মেডিক্যাল কাউন্সিল কেন পারছে না? কাউন্সিলের এক কর্তার যুক্তি, তাদের কাছে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ জমে। তার নিষ্পত্তিতে অনেক সময় যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য দফতরের তদন্ত রিপোর্টকে কি কাউন্সিল গুরুত্ব দেবে? রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্মল মাজির জবাব, ‘‘নিশ্চয়ই। আমরা আলাদা তদন্ত করলেও আমাদের ও স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট দু’টো বিচার করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। স্বাস্থ্য দফতরের অনুরোধে কেসের দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টাও করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy