Advertisement
২১ মে ২০২৪
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় ‘গাফিলতি’

অভিযোগ তুললেন খোদ এক স্বাস্থ্যকর্তাই

বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতি বা অহেতুক বিল বাড়ানোর অভিযোগ ওঠে হামেশাই। কিন্তু এ বার সেই অভিযোগ তুলে নিজের দফতর এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের দ্বারস্থ হলেন স্বয়ং এক স্বাস্থ্যকর্তা।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০০:৪২
Share: Save:

বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতি বা অহেতুক বিল বাড়ানোর অভিযোগ ওঠে হামেশাই। কিন্তু এ বার সেই অভিযোগ তুলে নিজের দফতর এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের দ্বারস্থ হলেন স্বয়ং এক স্বাস্থ্যকর্তা। ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পরে মৃত্যু হয়েছিল ওই স্বাস্থ্যকর্তার বাবা ত্রৈলোক্যনাথ মণ্ডলের। তবে শুধু তিনি নিজে নন, নবান্নে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটি অভিযোগের চিঠি পাঠিয়েছেন ওই স্বাস্থ্যকর্তার মা-ও। তাঁর প্রশ্ন একটাই, সন্তান স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চপদে থাকা সত্ত্বেও যদি তাঁদের এমন ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা হলে সাধারণ মানুষের হালটা ঠিক কেমন?

সিওপিডি-র (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেস) রোগী ত্রৈলোক্যনাথবাবুকে ওই হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল। অভিযোগ, সেখানে একের পর এক ওষুধ তাঁর ওপরে প্রয়োগ করা হলেও কোনও ‘ড্রাগ সেনসিটিভিটি’ পরীক্ষা করানো হয়নি। ওষুধ বাবদ হাসপাতাল তাঁর পরিবারের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, সেই পরিমাণ ওষুধও তাঁকে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকী, গোড়াতেই আইসিইউ-এ রোগীকে ঢোকানোর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ত্রৈলোক্যনাথবাবুর মেয়ে, তথা রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিভাগের সহ-অধিকর্তা তনুশ্রী মণ্ডল।

সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ওই হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার দিন সাতেক পরে ত্রৈলোক্যনাথবাবুর মৃত্যু হয়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের পাল্টা বক্তব্য, বাড়ি যাওয়ার পরে কী ভাবে অবস্থার অবনতি হল, সেটা তাঁদের জানার কথা নয়। তা ছাড়া, কেন রোগীর মৃত্যুর বেশ কিছু দিন পরে ওই অভিযোগ করলেন বাড়ির লোকেরা? কেন ছুটি হওয়ার সময়েই প্রসঙ্গটি তোলা হল না?

বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার এক্তিয়ার যে সরকারের নেই, সেই অজুহাত বারংবারই দেন স্বাস্থ্যকর্তারা। অথচ, ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় ওই হাসপাতালগুলিকে লাইসেন্স দেয় রাজ্য সরকার। কিন্তু তার পরেও ওই হাসপাতালগুলি কোন রোগের কী চিকিৎসা করছে, কোন চিকিৎসায় কত বিল হচ্ছে, সে ব্যাপারে কেন হস্তক্ষেপ করা হয় না, তার কোনও সদুত্তর মেলে না। দিন কয়েক আগে কল্যাণীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতি সংক্রান্ত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিইউ, আইটিইউ-এর চিকিৎসা-বিধি সম্পর্কে রাজ্যের কাছে হলফনামা চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে ‘স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল’ থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালের ব্যাপারে তাঁদের নির্দিষ্ট ভাবে কোনও ধারণা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, সেই উদাসীনতার কারণেই কি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ক্রমশ বাড়ছে?

তনুশ্রীদেবীর অভিযোগ, গত মার্চে তাঁর বাবাকে সিওপিডি সংক্রান্ত অসুস্থতার কারণে অ্যাপোলো গ্লেনেগেল্‌স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইমার্জেন্সি থেকে তাঁকে পাঠানো হয় আইসিইউ-তে। সেখানে তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিক, ড্রাগ থিনার, অ্যান্টি কোলেস্টেরল, অ্যান্টি গ্যাসট্রিক ইরিটেশন ইত্যাদির ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগে তাঁর শরীরে ওই ওষুধগুলির কোনও ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ভয় আছে কি না, ড্রাগ সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করে তা যাচাই করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালেও যে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, শহরের একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে কেন সেই পরীক্ষা না করে রোগীর উপরে ওষুধগুলি প্রয়োগ করা হবে?’’ ওই ওষুধগুলির জেরেই তাঁর বাবার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় বলে এক জন চিকিৎসক হিসেবে তনুশ্রীদেবীর অভিযোগ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বাবার হাইপারটেনশন বা ডায়াবেটিসের কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির পরেই ওই সমস্যাগুলি দেখা দেয়। ক্ষতি হয় তাঁর কিডনিরও। দ্রুত তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সেপসিসে মারা যান তিনি।’’ এখানেই শেষ নয়, অভিযোগ, হাসপাতালের ফার্মাসির বিলে বিশেষ একটি ইঞ্জেকশন যতগুলি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে টাকা নেওয়া হয়েছিল, আদতে দেওয়া হয়েছিল তার চেয়ে কম। কেন ‘অন্যায় ভাবে’ ওই টাকা নেওয়া হল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, দীর্ঘদিনের সিওপিডি রোগী ত্রৈলোক্যনাথবাবুকে যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল, তখনই তাঁর অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। সুতরাং হাসপাতালে ভর্তির পরে অবস্থার অবনতির অভিযোগ সঠিক নয়। ড্রাগ সেনসিটিভিটি পরীক্ষাও করা হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁরা। যদিও সেই পরীক্ষার কোনও রিপোর্ট হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। অকারণ চিকিৎসার বিল বাড়ানোর অভিযোগও মানতে চাননি তাঁরা। এক কর্তার কথায়, ‘‘১০ দিনে চিকিৎসার বিল হয়েছিল দু’লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসার বিল ৮৫ হাজার টাকা। বাকি এক লক্ষ ৪০ হাজার টাকা বিল হয় ফার্মাসির। তার সঙ্গে হাসপাতালের সম্পর্ক নেই। আর বেশি ওষুধ কেনানো হয়ে থাকলে, বাড়তি ওষুধ রোগীর পরিবারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’’ তনুশ্রীদেবী অবশ্য পাল্টা বলেছেন, হাসপাতালের ভিতরেই যখন ফার্মাসি, তখন তার দায়িত্বও হাসপাতাল এড়াতে পারে না। বাড়তি ওষুধ তাঁদের ফেরত দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তনুশ্রীদেবী। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে সমস্ত প্রমাণ আছে।’’

কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে কোনও অভিযোগই কার্যত যেমন ধামাচাপা পড়ে যায়, এ ক্ষেত্রেও কি ভবিতব্য সেটাই? স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘যেহেতু এই দফতরেরই এক কর্তা এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী, তাই আশা করা যায় আর কিছু হোক-না হোক, দ্রুত এ ব্যাপারে তদন্তটা অন্তত শুরু হবে। তা না হলে আমরা নিজেদের কাছেই বা কী জবাবদিহি করব?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Complaint heath officer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE