E-Paper

মানবজমিন ফসলে ভরে ক্ষত মুছে দেওয়ার আহ্বান

জীবনসঙ্গী গেরি, চার ছেলেমেয়ে, সাত নাতি-নাতনিতে ভরা সংসারের বাইরে আফগানিস্তানেও ‘মাম্মা হাইডি’ এখন সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। কট্টরপন্থীদের চোখেও ‘আমেরিকান, বিদেশিনি’ নন তিনি।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:৪০
An image of Mother

মাদার হাউসে শ্রদ্ধা জানাতে হাইডি কিউন। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

কলকাতায় আসার আগের রাতে হাইডি কিউন ফোনে বলছিলেন, হিংসাদীর্ণ এই বিশ্বে ভালবাসার ছোট ছোট মাদার টেরিজা-প্রতিম চেষ্টার কথা। মঙ্গলবার এ শহরে প্রথম বার এসে বিকেলে মাদার হাউসে গেলেন তিনি। যুদ্ধধ্বস্ত আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, ইজ়রায়েল, আজারবাইজান, ইরাক, ইউক্রেনে ক্ষুধা প্রতিরোধ ও কৃষির প্রসারের কাজে শরিক হাইডি। সিকি শতক ধরে ল্যান্ডমাইন সরিয়ে জাফরান খেত বা ফলের বাগান গড়ে তুলছেন।

এ বছর ওয়ার্ল্ড ফুড পুরস্কারে ভূষিত হাইডি বলছিলেন, “আমার জীবনেও ল্যান্ডমাইনের মতো মরণফাঁদ সার্ভাইক্যাল ক্যানসার বাসা বেঁধেছিল।” তখন তিনি সবে ৩০! পাঁচ, তিন এবং এক বছরের একরত্তি সন্তানদের ফেলে মরার কথাও ভাবতে পারছেন না। হাইডি বলেন, “যুদ্ধে মায়েদের বাচ্চার থেকে ছিটকে যাওয়ার কষ্টও আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝি! অস্ত্রোপচারের আগে ঈশ্বরকে বলতাম, জীবনটা কেড়ে নিয়ো না! মানুষের জন্য কাজের সুযোগ দাও!” এর আট বছর বাদে একই হাসপাতালে তাঁর কনিষ্ঠতম সন্তান ক্রিশ্চানের জন্ম! “ও আমার মিরাকল চাইল্ড! আমিও দ্বিতীয় জীবনে বাঁচছি”, বলছিলেন মধ্য ষাটের হাইডি।

জীবনসঙ্গী গেরি, চার ছেলেমেয়ে, সাত নাতি-নাতনিতে ভরা সংসারের বাইরে আফগানিস্তানেও ‘মাম্মা হাইডি’ এখন সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। কট্টরপন্থীদের চোখেও ‘আমেরিকান, বিদেশিনি’ নন তিনি। ২০০২-এর পরে বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ফল, জাফরান ফলিয়ে তা ভারতে বিপণনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ওই সব ফসলই এখন আফগানিস্তানের জিডিপি-র দুই শতাংশ। এই তালিবান জমানাতেও মেয়েদের চাষের নানা কাজে তালিম দিচ্ছেন তিনি। হাইডি বলছিলেন, “মেয়েরা কাজ শেখায় পুরুষদের কাছেও ওঁদের সম্মান বেড়েছে। আমার বিশ্বাস, পেট ভরা থাকলে কেউই অশান্তির পথে হাঁটবেন না।” বিশ্বের ৬০টি দেশে ছ’কোটি ল্যান্ডমাইন সরিয়ে ফসল ফলানোর লক্ষ্য তাই হাইডির চোখে শান্তির শিকড় বিস্তার। তাঁর সংগঠন ‘রুটস অব পিস’-এর শান্তি-সূত্র বা বিজ়নেস মডেল ফর পিস-ই দেশে, দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। অনেকের চোখে কৃষিকাজের নোবেল, ওয়ার্ল্ড ফুড পুরস্কারের উদ্ভাবক নিজেও নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী নর্ম্যান বরলগ। হাইডির আগে ভারতে সবুজ বিপ্লবের রূপকার এম এস স্বামীনাথন, গুজরাতের গ্রামে দুগ্ধ সমবায়ের দিশারী ভার্গিস কুরিয়েন বা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক মুহাম্মদ ইউনূসেরা একই পুরস্কার পেয়েছেন।

বর্ণময় জীবনে হাইডি কখনও বেথলেহেমে মুসলিম গাঁয়ের পাশে ল্যান্ডমাইন সরাতে গিয়েছেন, কখনও বা ইজ়রায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, প্যালেস্টাইনের মাহমুদ আব্বাস বা কাবুলে পালাবদলের পরেই তালিবানদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। আজকের যুদ্ধধ্বস্ত পৃথিবীতেও পতিত মানবজমিনে ফসল ফলানোর আশা ছাড়তে নারাজ হাইডি। বলছেন, “যে হাত বীজ বোনে, তা সাদা না কালো, মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু না ইহুদি, সে প্রশ্ন অবান্তর। সয়েল (মাটি) এবং সোল (আত্মা) আদতে একই।”

মুম্বই, কলকাতাতেও বাগানে ফলের বীজ রোপণ করে হাইডি আশার সঞ্চার করছেন। রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট শেখর মেহতার সঙ্গেও এ দিন দেখা করেন হাইডি। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের পিছিয়ে থাকা, কেন্দ্রের তা মানতে না চাওয়া এবং কর্পোরেটের জমি লুটের মতো সমস্যা সম্পর্কেও হাইডি ওয়াকিবহাল। তবু বলছেন, “ভারত গান্ধীর দেশ। শান্তির দিশারীরা বার বার ভারত থেকে উঠে এসেছেন। তাই বিশ্ব আজও ভারতের দিকে তাকিয়ে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mother House Christians Christianity Mother teresa peace Kolkata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy