—প্রতীকী ছবি।
এক দশক আগে বলিউডের ‘পেজ থ্রি’ ছবিটা সমসময়ের সংবাদমাধ্যম, গ্ল্যামারজগৎ বা শহুরে উচ্চকোটির জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি মেলে ধরেছিল। তাতে ছিল, জনৈক সম্ভ্রান্ত নারীর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকবাসরের দৃশ্যও।
মৃতের বাড়িতে মিডিয়ার ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি। ধবধবে সাদা সাফসুতরো পোশাকে হাজির ‘শোকার্তদের’ ভিড়। টিভি ক্যামেরার সামনে মাপা শোকের প্রতিক্রিয়া। সন্তর্পণে ‘ফুটেজ’ নেওয়ার পাশাপাশিই থাকছে ‘শোকগ্রস্তদের’ মধ্যে অস্ফুটে পারস্পরিক রাগ-বিদ্বেষের দাঁত কিড়মিড়। সব মিলিয়ে মৃতার পরিজনের প্রতি সহমর্মিতার সমাবেশও যে এক ধরনের শোকের থিমপার্টি হয়ে উঠতে পারে, তা মালুম হচ্ছিল ছবিটি দেখতে দেখতে।
তখনও সোশ্যাল মিডিয়া এতটা সর্বত্রগামী হয়নি। এ যুগে শোকের চেহারাটার একটা ডিজিটাল সংস্করণও কিন্তু ফুটে উঠছে। গত দিন ১০-১২ ধরে নেটরাজ্যে বাংলার বিশিষ্টদের জগত নিয়েও শোকের আবহ। কেউ মারা যেতেই ফেসবুক-টুইটারে হ্যাশট্যাগের প্রয়োগ বা #আরআইপি লেখা এ কালে যুগধর্ম। এমনকি, গুণিজনেরা কেউ চলে গেলে, সোশ্যাল মিডিয়াতেই অন্য নামজাদা বা প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়ারও হদিস মেলে।
আরও পড়ুন: হ্যাল ধুঁকছে আর্থিক সঙ্কটে! প্রকাশ্যে এল রিপোর্ট
আরও পড়ুন: কর্মী নেই, রেকের দুর্দশা, মেট্রোর বেহাল ছবি, অন্তর্তদন্তে আনন্দবাজার
সেই সঙ্গে বিশিষ্টদের প্রয়াণের খবর পাওয়া মাত্র টাটকা শোকবার্তা কিংবা অপটু কবিতা লিখে ‘লাইক’ গোনাগুন্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, এমন নমুনা ভুরি-ভুরি মিলবে। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম এই প্রবণতায় কিছুটা মুখ টিপে হাসছেন! তাঁর কথায়, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও নামী কারও মৃত্যু নিয়ে লেখা যাবে না, তা বলছি না!
কিন্তু এ বিষয়ে আমার মতামত একটু কড়া। অনেক ক্ষেত্রেই এক রকম শোকের বিজ্ঞাপন বা এগজিবিশনিজ়মের প্রবণতাও দেখতে পাচ্ছি।’’ বাঙালির বিষয়ে পুরনো বদনাম, সে সত্যজিৎ রায়কে ‘মানিকদা’ ছাড়া ডাকে না! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বা মৃণাল সেনের প্রয়াণের পরেও স্বল্পপরিচিতদের ঘনিষ্ঠতা জাহির করার প্রবণতা নিয়ে কানাকানি শোনা যাচ্ছে।
তবে নামী কেউ মারা গেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে চর্চাটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে করেন বেশির ভাগ লোকই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অন্তর্ধান পটে হেরি তব রূপ চিরন্তন’। মৃত্যুর অভিঘাতে একটা মানুষকে নতুন করে আবিষ্কারও ঘটেই। তা ছাড়া, শ্রীদেবী বা ঋতুপর্ণ ঘোষের অকালপ্রয়াণে আলোড়িত না-হওয়াটাই অস্বাভাবিক। অখ্যাত ভক্তদের লেখা কিছু মূল্যবান শোকগাথা বা অবিচুয়ারিও অনেক সময়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এখানেই ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত বলে মনে করেন লেখিকা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার দিব্যেন্দু পালিতের চলে যাওয়ার খবর পেয়ে প্রিয় লেখকের ‘স্মার্ট গদ্যে’র কথা দু’ছত্রে ফেসবুকে লিখেছেন তিনি। সঙ্গীতা বলছিলেন, ‘‘কিছু মৃত্যুর সঙ্গে স্বজনবিয়োগের কষ্ট মিশে থাকে। অনেক সুখস্মৃতি ভিড় করে। দিব্যেন্দুদার খবরটাও আমার কাছে তেমনই।’’ তবে তিনি মনে করেন, ‘‘অনেক মানুষ যাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, তাঁর বিষয়ে মরিয়া হয়ে তাৎক্ষণিক কিছু বলতেই হবে, এই ভাবটা আমার ভাল লাগে না।’’
যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপে মৃণাল সেনের প্রয়াণের দিন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু গদ্য। তাতে একটা কাল্পনিক দৃশ্য, কোনও ‘পরলোকে’ বাংলার এক ঝাঁক চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, গায়ক-শিল্পীরা এক সঙ্গে শিল্পসৃষ্টি করছেন। নামী পরিচালক বা নায়কের সিনেমার নাম পরপর সাজিয়ে অদ্ভূত বাক্য রচনার ঝোঁকও চোখে পড়ছে। জয়রঞ্জন রামের মতে, ‘‘কে কী ভাবে কোন ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেবেন, তা তো আগাম বলা যাবে না। তবে কখনও আমরা শোকের আতিশয্যে নিজেদের হাসির খোরাক করে ফেলি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy