তৃষ্ণা: পথিকের জন্যেও ভাবে এ পাড়া। নিজস্ব চিত্র
এক দিকে জোড়াসাঁকো, অন্য দিকে পাথুরিয়াঘাটা। এই দুইয়ের মধ্যে রবীন্দ্র সরণি থেকে শুরু হয়ে আমাদের পাড়া হালওয়াসিয়া রোড গিয়ে মিশেছে কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে। নামটা শুনে মনে হয় অবাঙালি পাড়া। কিন্তু আসলে এটা এক কালের বর্ধিষ্ণু বাঙালিপাড়া। যদিও এখন বাঙালির সংখ্যা কার্যত হাতে গোনা।
সকাল থেকে গভীর রাত— আমার পাড়া সব সময়েই ভীষণ ব্যস্ত। কাছেই নতুনবাজার, অন্য দিকে পোস্তা। এখানে যাঁরা থাকেন, সকলেই কোনও না কোনও ব্যবসায় যুক্ত। অধিকাংশই অবাঙালি। তাঁরা সব সময়েই একে অন্যের খবর রাখেন। পাশে দাঁড়ান বিপদ-আপদে।
পোস্তা থেকে জোড়াসাঁকো— এই ছিল আমাদের পাড়ার চৌহদ্দি। পাশেই খেলাতবাবু লেন। পাড়ার অন্য দিকে যে বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির, সেখানে আগে ছিল রমানাথ ঠাকুরের বাড়ি। এখন তো নতুন করে কোনও বাঙালি পরিবারকেই আর আসতে দেখি না।
ছোটবেলার পাড়া আর আজকের পাড়া যেন দুই ভিন্ন জগৎ। পাড়ার মুখেই রয়েছে দুধের বাজার। ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে শুরু হয়ে যায় বিকিকিনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসেন বহু ক্রেতা। আগে রাস্তাতেই চুটিয়ে চলত ক্রিকেট ও ফুটবল। যোগ দিত পাশের পাড়ার ছেলেপুলেরাও। এখন গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে সেই খেলার মেজাজ। তবে কখনও বাড়ির উঠোনে, কখনও আবার কাছের পার্কে খেলে কচিকাঁচারা। অতীতে এ পাড়ায় সন্ধ্যা হলেই বসত তাসের আসর। সেটাও আজ আর নেই। রকে বসে আড্ডাটাও এখন আর হয় না।
কাছেই আছে কয়েকটি বিখ্যাত কালীমন্দির। যেমন পুঁটেকালীর মন্দির, তারা মা তলা আর জোড়াসাঁকো কালীমন্দির। প্রাচীন একটি লক্ষ্মীমন্দিরও আছে। অতীতে এ অঞ্চলে ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হতো। আমাদের পাড়ায়, তারাসুন্দরী পার্কের কাছে বসত গানের জলসা। তাতে কে না এসেছেন! কিশোরকুমার, মান্না দে থেকে শুরু করে কত দিকপাল। এখনও পুজো হয়, তবে সেই জৌলুস আর নেই। তারাসুন্দরী পার্কের কাছে মল্লিকদের বাড়িতে ষষ্ঠীর সকালে শোনা যেত শ্রীশ্রীচণ্ডী সঙ্গীতালেখ্য। গান গাইতে আসতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা। তেমনই, আমাদের পারিবারিক জগদ্ধাত্রী পুজোও শতাধিক বছরের প্রাচীন।
এলাকার একটা বড় সমস্যা পার্কিং। বেশিরভাগ বাড়িতে গ্যারাজ না থাকায় রাস্তাতেই থাকে গাড়ি। কখনও আবার রাস্তার দু’দিকেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ফলে মানুষজনকে রাস্তার মাঝখান দিয়েই যাতায়াত করতে হয়।
আশপাশে রয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। তবে একটাই আক্ষেপ, কমতে কমতে তেলেভাজার দোকানের সংখ্যা ঠেকেছে দু’-একটিতে। প্রাদেশিক প্রভাবে নতুন বাজারে কমেছে মাছের আমদানিও। ভাল মাছ পেতে ভরসা সেই মানিকতলা বাজার। কাছাকাছি নেই ভাল কোনও রেস্তোরাঁ। হারিয়ে গিয়েছে কুলফি-মালাই, ঘুগনিওয়ালা। ক্কচিৎ শোনা যায় শিল কাটাই আর ঝালমুড়িওয়ালার ডাক।
অনেক ‘নেই’, তবু পাড়ার টানটা রয়ে গিয়েছে। হয়তো সেটাই এই অঞ্চলের ‘ইউএসপি’।
লেখক আইনজীবী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy