E-Paper

‘অদম্য জেদ থাকলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কিছুই বাধা নয়’

২০১৩ সালে যেখানে ভারতে মোট প্রতিস্থাপিত হয় ৪৯৯০টি অঙ্গ, সেখানে ২০২২ সালে তা হয়েছে ১৬০৪১। চাহিদার তুলনায় এই বৃদ্ধি নামমাত্র, বলছেন চিকিৎসকেরা। অঙ্গদানে অনীহার অন্যতম কারণ মূলত কিছু ভ্রান্ত ধারণা।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৭
(বাঁ দিকে) অনিমেষ বাগদি এবং অনিরুদ্ধ বাগদি।

(বাঁ দিকে) অনিমেষ বাগদি এবং অনিরুদ্ধ বাগদি। —ফাইল চিত্র।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থেকে প্রতিদিন এ দেশে মৃত্যু হচ্ছে ২০ জনের। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজ়েশনের ২০২৩ সালের ২০ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রতীক্ষায় আছেন ৪৯,৭৪৫ জন। ২০২২ সালে সারা দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে ১৫৫৬১টি। ২০১৩ সালে যেখানে ভারতে মোট প্রতিস্থাপিত হয় ৪৯৯০টি অঙ্গ, সেখানে ২০২২ সালে তা হয়েছে ১৬০৪১। চাহিদার তুলনায় এই বৃদ্ধি নামমাত্র, বলছেন চিকিৎসকেরা। অঙ্গদানে অনীহার অন্যতম কারণ মূলত কিছু ভ্রান্ত ধারণা। প্রতিস্থাপনের বিপুল খরচও আর একটি বাধা।

তবে, এই দুই বাধা পেরোনো সম্ভব সচেতনতা এবং প্রচারের সাহায্যে। সেই লক্ষ্যেই আজ, ১৩ অগস্ট তারিখটি ‘বিশ্ব অঙ্গদান দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়। কিন্তু, সমাজের সর্বস্তরে এ নিয়ে রয়েছে কুসংস্কার। সে সব ছাপিয়ে লড়াই জেতার উদাহরণও রয়েছে আশপাশে।

তেমনই এক উদাহরণ ভূদেব বাগদি এবং ছবি বাগদি। মুর্শিদাবাদের বিছুর গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় রাজমিস্ত্রি ভূদেবের পরিবারে আছেন স্ত্রী ও দুই ছেলে। জন্মের পরপর দুই ছেলেরই ধরা পড়েছিল জন্ডিস। ধীরে ধীরে চোখ, প্রস্রাবের রং হলুদ হতে থাকে, পেট ফোলা শুরু হয়। দিনভর হাত-পা চুলকে যেত দুই শিশু। একাধিক ডাক্তার দেখিয়েও ফল হয়নি। ধার-দেনা করে ভূদেব ভিন্ রাজ্যে নিয়ে যান বড় ছেলেকে। জানা যায়, সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত বালক। সুস্থ করতে লিভার প্রতিস্থাপনই একমাত্র পথ। বিপুল খরচের অঙ্ক শুনে ফিরে আসেন ভূদেব।

এর পরে তিনি ছেলেকে নিয়ে যান এসএসকেএমে। সেখানে কয়েক বছর চিকিৎসার পরে ঠিক হয়, ভূদেবের স্ত্রী ছবির লিভারের অংশ নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে বড় ছেলের শরীরে। বাধা হন ছবির বাবা-মা। প্রবল আপত্তি তোলেন। বলা হয়, লিভারে ছুরি ঠেকালেই মৃত্যু হবে তাঁদের মেয়ের। এসএসকেএম থেকে সিনিয়র চিকিৎসক গ্রামে গিয়েও পরিবারটিকে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি।

এমন পরিস্থিতিতে ত্রাতা হন ভূদেবই। রাতের অন্ধকারে স্ত্রী ও ছেলেকে লুকিয়ে এসএসকেএমে এনে অস্ত্রোপচার করান। ১৩ বছর আগে, দিনমজুর ভূদেবের দৈনিক মজুরি তখন ২৫০ টাকা। পরের ছ’মাস হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠানো হয় বড় ছেলে অনিমেষকে। সেই দীর্ঘ সময়ে এসএসকেএমের চিকিৎসকেরাই অনিমেষের ওষুধের খরচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁদেরই সহায়তায় কাঁচা মাটির ঘর পাকা হয় ভূদেবের। শৌচাগারও তৈরি হয়। ২০১৯ সালে একই রকম লড়াই করে শাশুড়ির লিভারের অংশে সুস্থ হয় ছোট ছেলে অনিরুদ্ধ। বড় ছেলে বর্তমানে স্নাতকে বাণিজ্য নিয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি, বাবাকে জোগাড়ের কাজে সাহায্যও করেন অনিমেষ। অনিরুদ্ধ উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া।

প্রবল অভাব সত্ত্বেও এত বড় অস্ত্রোপচারের পরে দুই সন্তানকে কী ভাবে সংক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন, সে কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠছিল ছবির গলা। প্রতি মুহূর্তে হাত ধোয়া, জামাকাপড়-চাদর পরিষ্কার রাখা, রোগীর ঘরে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া, সাধ্য মতো অল্প তেল-মশলায় রান্না করা খাবার ছেলের মুখে তুলে দেওয়া, প্রতিদিন ছেলেকে স্নান করানো— সব দায়িত্ব একা সামলেছেন। দুই ছেলের বেলাতেই। এখনও ছেলেদের খাবার নিয়ে সচেতন ছবি।

এসএসকেএমে অনিমেষ ও অনিরুদ্ধের চিকিৎসক-দলের প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘ভূদেব হলেন সেই সমাজের, যাঁদের কিছুই নেই। শুধু একটা কাঁচা মাটির ঘর, স্ত্রী আর অসুস্থ দুই ছেলে ছিল। কিন্তু, স্পার্টাকাসের মতো ওঁর একটা বড় হৃদয় আছে। তাই কিছু না থাকাটা, ওঁর কোনও বাধা নয়। ভূদেব এটাই মানেন, আমায় জিততে হবে। এবং সে জন্য ঝুঁকি নিতেই হবে। এমন অদম্য জেদ থাকলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনও বাধাই বাধা নয়।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Organ Transplantation Organ Donation awareness

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy