Advertisement
০২ মে ২০২৪

‘নজরানা’ দিলেই ছাড় অবৈধ দোকানকে

অভিযোগের আঙুল শাসক দলের কাউন্সিলর জীবন সাহার দিকে। কলকাতা পুরসভার ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। তাঁরই এলাকায় বেলেঘাটার সাউথ শিয়ালদহ রোডের গা ঘেঁষে পামারবাজারের চুনাপট্টি এলাকায় একটি উদ্যান তৈরির কাজ চলছে।

উদ্যানের পাশে এ ভাবেই গড়ে উঠছে দোকান। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

উদ্যানের পাশে এ ভাবেই গড়ে উঠছে দোকান। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

মেহবুব কাদের চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০২:৪৩
Share: Save:

বেআইনটাই এখানে আইন।

যাঁর হাতে ক্ষমতা, আইন তাঁরই তর্জনীর ইশারায় নাচে।

অভিযোগের আঙুল শাসক দলের কাউন্সিলর জীবন সাহার দিকে। কলকাতা পুরসভার ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। তাঁরই এলাকায় বেলেঘাটার সাউথ শিয়ালদহ রোডের গা ঘেঁষে পামারবাজারের চুনাপট্টি এলাকায় একটি উদ্যান তৈরির কাজ চলছে। অভিযোগ, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে সেই পার্ক লাগোয়া ফুটপাথে দোকানঘর তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এবং সেই দোকানঘরের জন্যও দাবি করা হচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছেন জীবনবাবু।

খবর নিয়ে জানা গিয়েছে, এ ভাবে ফুটপাথের উপরে দোকানঘর তৈরির জন্য পুরসভার যে অনুমতির প্রয়োজন, তা-ও নেই ওই কাউন্সিলরের কাছে। তাঁরই দলের নেতা, কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার খবর শুনে বলেন, ‘‘উদ্যান লাগোয়া ফুটপাথে কোনও নির্মাণকাজ করাটাই বেআইনি। আমি বিষয়টি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

জীবনবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘পার্ক তৈরির আগে এখানে বেশ কিছু দোকান ছিল। সেই দোকানদারদেরই উদ্যানের পাশে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে।’’ ওই এলাকা ঘুরে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, উদ্যান তৈরির আগে ওই জায়গায় মাত্র তিনটি দোকান ছিল। অথচ পুনর্বাসনের সময়ে ৫০টি দোকানঘর তৈরি করা হচ্ছে। জীবনবাবু অবশ্য সে কথা মানতে চাননি।

এলাকায় ঘুরে জানা গিয়েছে, তিন বছর আগে উদ্যান তৈরির সময়ে ওই তিনটি দোকানের মধ্যে একটি চায়ের দোকান ছিল স্থানীয় বাসিন্দা বিমল চক্রবর্তীর। উদ্যান নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পরে বিমলবাবুর দোকান ভেঙে দেওয়া হয়। জানা গিয়েছে, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, উদ্যানের কাজ শেষ হওয়ার পরে এই এলাকায় তাঁকে একটি দোকান করে দেওয়া হবে।

রবিবার বিমলববাবু বলেন, ‘‘পার্কের পাশে এখন যে ঘর তৈরি হচ্ছে তাতে আমারও একটি দোকান বুকিং করা আছে। ইদানীং স্থানীয় তৃণমূল নেতারা বলছেন, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। কিন্তু এত টাকা আমি পাব কোথায়?’’ ষাটোর্ধ্ব ওই ব্যক্তির আক্ষেপ, ‘‘দু’দিন আগে কাউন্সিলর এখানে এসেছিলেন। তাঁকে হাতজোড় করে বলেছি, বাবু আমি গরিব মানুষ। এত টাকা দেওয়ার আমার ক্ষমতা নেই। কাউন্সিলর আমাকে কোনও আশ্বাস দেননি। জানি না, ঘরটা পাব কি না।’’

যার অর্থ যাঁদের দোকান ছিল, তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার নাম করে টাকা তোলা হচ্ছে। আর অতিরিক্ত যে ঘর তৈরি হচ্ছে, তা থেকে বড় অঙ্কের মুনাফার পরিকল্পনা করা হয়েছে। জীবনবাবু এ সমস্ত অভিযোগই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি এ সবের সঙ্গে জড়িত নন।

চুনাপট্টি এলাকায় প্রায় পাঁচ বিঘা জমি জুড়ে এই উদ্যান তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে। ব্রিটিশ আমলে বেলেঘাটার সার্কুলার ক্যানাল থেকে পামারবাজার পর্যন্ত হাতির শুঁড়ের মতো খালের একটি শাখা ছিল। আবর্জনা জমে জমে ধীরে ধীরে তা শুকিয়ে যায়। পরে জঞ্জালভর্তি ওই জমির উপরে উদ্যান তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় পুরসভা।

রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গিয়েছে, উদ্যানের চারপাশ রেলিং দিয়ে ঘেরার কাজ শেষ হয়েছে। একইসঙ্গে উদ্যান লাগোয়া ফুটপাথে প্রায় ১০-১২টি ছোট ছোট দোকান তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নির্মাণকর্মীরা বলেন, ‘‘পার্টি অফিস থেকে কাজ করানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে ৫০টির মতো দোকানঘর হবে।’’

উদ্যান নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগেই রাস্তার পাশে এ ভাবে ফুটপাথ জুড়ে অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয়েরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এলাকায় উদ্যান হলে পরিবেশের পক্ষে খুব ভাল। কিন্তু উদ্যান শেষ হওয়ার আগেই যে ভাবে চার দিকে অবৈধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে তাতে আমাদের উদ্বেগ, সবুজায়নের আদর্শ পরিবেশ আদৌ থাকবে তো?’’

কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘উদ্যান লাগোয়া ফুটপাথে কোনও ভাবেই নির্মাণকাজ চলতে পারে না। এই নির্মাণের কথা কলকাতা পুরসভাকে জানানো হয়নি। কে বা কারা এই কাজ করছে জানি না। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর এ বিষয়ে ভাল জানবেন।’’

জীবন সাহার যুক্তি, ‘‘উদ্যান তৈরির আগে যাঁদের এখানে দোকান ছিল, তাঁদের জন্য দোকান তৈরি করা হচ্ছে। এই দোকান না তৈরি করা হলে ওঁরা কোথায় যাবেন?’’

বেলেঘাটা বিধানসভার সিপিএম প্রার্থী রাজীব বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘এলাকার কাউন্সিলরের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে উদ্যানের পাশে এই নির্মাণ পুরোপুরি বেআইনি। পুর-কর্তৃপক্ষ এই বেআইনি নির্মাণ ভাঙার ব্যবস্থা না করলে আমরা আন্দোলনে নামব।’’ যা অস্বীকার করে জীবনবাবুর বক্তব্য, ‘‘এ সব সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমাকে হেয় করতেই সিপিএম কুৎসায় নেমেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Park Illegal shop Councilor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE