Advertisement
E-Paper

শত কষ্টেও মুখ ফুটত না মেয়ের

বুধবার সেই মেয়ে, শ্রাবন্তী মিত্রের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে সুভাষনগরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে। তাঁকে নিয়ে অভিযোগের পর অভিযোগ শুনে তখন সেই বাড়িতেই বসে চোখের জল ফেলছিলেন মা। মাথা নিচু করে বসেছিলেন জামাইবাবু। এত অসম্মান মেনে নিতে পারেননি শ্রাবন্তী।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০১:৪৯
স্মৃতি: ছোট মেয়ের আঁকা ছবি দেখাচ্ছেন মা, বাবা, দিদি। শুক্রবার, মধ্যমগ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

স্মৃতি: ছোট মেয়ের আঁকা ছবি দেখাচ্ছেন মা, বাবা, দিদি। শুক্রবার, মধ্যমগ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

নুন আনতে পান্তা ফুরোনো সংসারে একটা মেয়েকে দিনের পর দিন স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে, পড়িয়ে-শুনিয়ে এমএ পাশ করানো কি চাট্টিখানি কথা? কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন সদ্য মেয়ে হারানো মা সুপ্রীতি বসু।

মেয়েও বরাবর মান রেখেছেন বাবা-মায়ের এই কষ্টের। পড়াশোনা, নাচ, গান, ছবি আঁকা— সবটাই করেছেন নিখুঁত ভাবে, মন দিয়ে।

বুধবার সেই মেয়ে, শ্রাবন্তী মিত্রের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে সুভাষনগরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে। তাঁকে নিয়ে অভিযোগের পর অভিযোগ শুনে তখন সেই বাড়িতেই বসে চোখের জল ফেলছিলেন মা। মাথা নিচু করে বসেছিলেন জামাইবাবু। এত অসম্মান মেনে নিতে পারেননি শ্রাবন্তী।

গরিব বাবার গুণী মেয়ের অভিধানে ‘অভিযোগ’ শব্দটিই যে ছিল না। সব অবস্থায় মানিয়ে চলতে শিখেছিলেন তিনি। শুক্রবার বাবা হরিপদ বসুর সে সব কথাই মনে পড়ছিল। তিনি বলেন, ‘‘ও তখন সেভেনে পড়ে। আমি হাত দু’টো ধরে বললাম, মা, আমি যে তোকে আর পড়াতে পারিনে। মেয়ে গলা জড়িয়ে বলল, বাবা তুমি শুধু বছরে এক বার নতুন ক্লাসে উঠলে পুরনো বই কিনে দিও। আর কিছু লাগবে না।’’ কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে যাচ্ছিল হরিপদবাবুর। ছবি এঁকেই কোনও রকমে সংসার টেনেছেন তিনি।

মা, বাবা পালা করে করে দেখাচ্ছিলেন শ্রাবন্তীর হাতের কাজ। একটা চালের উপরে ভারতের মানচিত্র। ক্রাফট পেপার দিয়ে মাছের চাঁদমালা। পেন্সিল স্কেচ। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক পেন্টিং। মা বলে চলেন, ‘‘এটাও ওর হাতে তৈরি।’’ শিল্পী বাবা আবার জানান, ‘‘ওকে এ সব শেখাতে হয়নি। নিজে থেকেই করত।’’

আরও পড়ুন: শ্রাবন্তীর অভিমান জানত শুধু তাঁর ডায়েরি

মধ্যমগ্রামের ঘরে তখন ছড়ানো শ্রাবন্তীর টাটকা সব স্মৃতি। ভিড় করেছেন পড়শি, স্বজন। কেউ বলছেন, ‘কোনও দিন ভুরু কুঁচকে কথা বলতে দেখিনি।’ কেউ বলছেন, ‘কষ্ট হলেও মুখ ফুটে কিছু বলত না মেয়েটা। সব সময়ে হাসি মুখ।’ শ্রাবন্তীর দিদি শবরী গঙ্গোপাধ্যায়। বলছিলেন, ‘‘ও ছিল মুখচোরা। শত কষ্টেও মুখ ফুটত না। ওর প্রচণ্ড আত্মসম্মানে লেগেছিল। এই ঘটনায় একটা শিক্ষিত মেয়ের আত্মসম্মানে লাগবে না?’’ শবরী বলেন, ‘‘এত কিছু জানত। নাচ, গান, ছবি আঁকা। প্রতিযোগিতায় নাম দিলেই ফার্স্ট হতো।’’ শবরীর অভিযোগ, ‘‘দু’-এক বার হোয়াটস্‌অ্যাপে শ্বশুরবাড়ির কথা লিখেছিল। ভাসুর ওর স্বামীকে বলেছেন, ‘তোর বৌ ভাল না।’ ওর কথা পুলিশে জানিয়ে রাখতে বলেছিলেন। তবু ওর স্বামী প্রতিবাদ করেননি। বুঝতে পারছিলাম, ও ভাল নেই।’’ কিন্তু কতটা খারাপ ছিলেন বোন, তা জানার আগেই সব শেষ।

পরিবারের লোকেরাই জানালেন, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি শ্রাবন্তী। পড়াশোনাই ভালবাসতেন। দিন কাটত বই নিয়ে। সঙ্গে ছিল চাকরি করে বাবা-মাকে দেখার পরিকল্পনা। কিন্তু অভিযোগ, ছেলের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য জোরাজুরি থামছিলই না। জানুয়ারিতে এমএ ফাইনাল দিয়েই শ্রাবন্তীর বিয়ে হয়ে যায় ফেব্রুয়ারিতে। রেজাল্ট বেরোনোর আগেই। রেজাল্ট বেরিয়েছে। আনা হয়নি তা-ও।

বিয়ের এক বছরের মাথায় মেয়ে-জামাইয়ের ঘরে আসার কথা। দ্বিরাগমনের সেই আচারের জন্য বিয়ের কিছু জিনিসপত্র এখনও রাখা ঘরে। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন শ্রাবন্তীর মা সুপ্রীতিদেবী। বলে ওঠেন, ‘‘সব মিথ্যে। জাঁক দিয়ে বিয়ে, পুরোহিতের সামনে মন্ত্র-ফন্ত্র। সব!’’

কথার ফাঁকে মাঝেমধ্যেই বাইরে গিয়ে চোখ মুছে আসছিলেন দেবাশিস দত্ত। কে তিনি? ‘‘পাশের বাড়ি। মামা বলত। জানেন, যে দিন ও জন্মাল, আমার মা ওকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছিল। আর কাল আমার কাঁধে চড়েই চলে গেল।’’ হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন মামা। বলেন, ‘‘শুধু জামাই ধরা পড়েছে। পুলিশ এখনও বাকিদের ধরল না। এমন ভাল একটা মেয়েকে যারা তিলে তিলে মারল, তাদের কঠিন শাস্তি চাই।’’

Shrabanti Mitra Biswadev Mitra Death Suicide Introvert
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy