Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
scavenger

শ্রমিকের মর্যাদা পেতে অনেক লড়তে হয়েছে কলকাতার ধাঙড়, মেথরদের

আধুনিক ভারতে শহরকেন্দ্রিক যে নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে, তার নীচের তলার মানুষদের অবস্থান ও জীবনযাপনের দিকে সাধারণত শিক্ষিতসমাজ নজর দেন না। অথচ এই নীচের তলার মানুষদের ছাড়া শহরের অস্তিত্বই পদে পদে বিপন্ন হতে বাধ্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৫:৪৫
Share: Save:

আধুনিক ভারতে শহরকেন্দ্রিক যে নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে, তার নীচের তলার মানুষদের অবস্থান ও জীবনযাপনের দিকে সাধারণত শিক্ষিতসমাজ নজর দেন না। অথচ এই নীচের তলার মানুষদের ছাড়া শহরের অস্তিত্বই পদে পদে বিপন্ন হতে বাধ্য। ধাঙড় বা মেথর, এমনই এক শ্রেণি বা সম্প্রদায়, যাঁরা শহরের যাবতীয় ময়লা ও বর্জ্য পদার্থ প্রতিদিন সাফ করার সঙ্গেই শহরবাসীকে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। সম্প্রতি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তনিকা সরকার কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসাবে গড়ে ওঠার সময় থেকে এই ধাঙড়দের ভূমিকা ও ১৯২০র দশকে তাঁদের ঐতিহাসিক ধর্মঘটের প্রেক্ষিতের দিকে আলোকপাত করেছেন। ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সি আর জি) এবং রোজা লুক্সেমবুর্গ স্টিফটুং এর যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় সম্প্রতি দু’দিন ধরে সমাজ ও রাজনীতিতে গণ আন্দোলনের প্রভাব শীর্ষক এক আলোচনাচক্রে অংশ নিয়ে অধ্যাপিকা তনিকা সরকার কলকাতার ধাঙরদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট ও তার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করেন।

তনিকা সরকার মনে করিয়ে দেন, ইংরেজরা গঙ্গার পূর্ব তীরে যে শহর কলকাতার পত্তন করেছিল, তা তৈরি হয়েছিল প্রধানত পলিমাটিতে আবৃত এলাকার উপর। তখনও কলকাতার অনেকটাই জঙ্গল ছিল। ব্রিটিশদের পরিকল্পিত শহর তৈরি শুরুই হয় জঙ্গল সাফ ও গাছ কাটার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া কলকাতার পূর্ব দিকে নোনা জলাভূমি (যেমন সল্ট লেক) ছিল। গোড়ায় শহরের বর্জ্য পরিষ্কার করার কোনও আধুনিক পরিকল্পনা ছিল না। সরাসরি সল্ট লেকের জলে এনে ফেলে দেওয়া হত শহরের যাবতীয় বর্জ্য। তিনি মনে করিয়ে দেন, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে (যা বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলে কুখ্যাত) কলকাতা ও আশপাশের ৭৬,০০০ মানুষ মারা গেলে তাঁদের মৃতদেহও বিভিন্ন জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৬ পর্যন্ত সরকারি ভাবেই শহরের যাবতীয় ময়লা ও বর্জ্য সল্ট লেকে ফেলা হত। তখনও ভূগর্ভস্থ ময়লা নিষ্কাশনী ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ফলে, মানুষের মলও নির্বিচারে নদীতে ফেলা হত। এ সবের কারণে, কলকাতায় মাঝে মধ্যেই মহামারী হওয়াটা ছিল রুটিন ব্যাপার। প্রশাসনের মতে, শহরবাসীর (বিশেষত গরিবদের মধ্যে) যত্রতত্র মলত্যাগের অভ্যাস ছিল মহামারী হওয়ার অন্যতম কারণ।

১৮৯০ নাগাদ শহর কলকাতার হোয়াইট টাউন বা ইউরোপীয়দের বসবাসের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন বসানো হয়। তার কিছু দিন আগে থেকেই ধনী এদেশীয়রাও কেউ কেউ ব্ল্যাক টাউন ছেড়ে হোয়াইট টাউনে বাস করতে শুরু করেছেন। কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতা কর্পোরেশন নল বাহিত পরিস্রুত জল দেওয়া শুরু করে। তখন এই ব্যবস্থা অনেক ইউরোপীয় শহরের পানীয় জল বন্টন ব্যবস্থার চাইতে উন্নত ছিল। ১৮২০ সালে গঙ্গার ধারে পলতায় পানীয় জলের পাম্পিং স্টেশন চালু হয়।

আরও পড়ুন: কেউ পেলেন না, কেউ দু’হাজারি নিলেন না

১৮৮০ সালের হিসেবে দেখা যায়, শহরের ৪০,০০০ বাড়ির মধ্যে মাত্র ৬,০০০ বাড়িকে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত করা গিয়েছে। ওই সময় কলকাতায় নথিভুক্ত ধাঙড় বা মেথরের সংখ্যা ১১,০০০ এবং তাঁরা ২৪,০০০ বাড়ির ময়লা প্রতিদিন পরিষ্কার করার দায়িত্বে ছিলেন। এই ধাঙড়রা কলকাতাতেই বাস করতেন। কিন্তু তাঁদের থাকার জায়গাগুলি ছিল খুবই নিম্নমানের। তা ছাড়া ধাঙড়দের পরিবারের স্বাস্থ্য বা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ইত্যাদি নিয়ে কোনও ব্যবস্থাই কলকাতা কর্পোরেশনের তরফে করা হয়নি। জাতীয় কংগ্রেসের অনেক নেতা, যেমন চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বা সুভাষচন্দ্র বসু বিভিন্ন সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের দায়িত্বে থাকলেও মেথর বা ধাঙড়দের সমস্যা নিয়ে কখনই মাথা ঘামাননি। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একাংশকে কর্পোরেশনে কাজ পাইয়ে পুনর্বাসন দিতেই কংগ্রেস নেতাদের আগ্রহ ছিল বেশি। এই অবস্থায় কমিউনিস্টরা মেথরদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। ১৯২৪ সালে কলকাতার মেয়র হিসেবে সিআর দাশ প্রথম বার কলকাতার ধাঙড়দের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন। বাস্তবে, ধাঙড়দের বেড়ে চলা ক্ষোভের নিরসনের চেষ্টায় তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হন। ওই সময় থেকেই শহরের শিক্ষিত সমাজের একাংশের মধ্যে ধাঙড়দের নিয়ে চিন্তভাবনা শুরু। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের নিয়ে কবিতা লেখেন "কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য অশুচি..."। রবীন্দ্রনাথ সেই কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে মডার্ন রিভিউতে প্রকাশ করেন। এমনকী দেশের অন্য প্রান্তে গাঁধীজি তখন এই মেথর ধাঙড়দের হরিজন আখ্যা দিয়ে তাদের বর্ণভিত্তিক হিন্দু সমাজে জলচল করার চেষ্টা শুরু করছেন। রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় উপন্যাসে গান্ধীজির ওই আন্দোলনকে নিছকই প্রতীকি ব্যাপার বলে ব্যঙ্গ করা হয়।১৯২০-র দশকেই মুসলমান সমাজে নারীশিক্ষায় উদ্যোগী বেগম রোকেয়া ধাঙড়দের অবস্থার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেন। তিনি মুসলমান নারীদের ধাঙড়বস্তি পরিদর্শন করে সচক্ষে তাঁদের অবস্থা দেখার আহ্বান জানান। অন্য দিকে, শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী প্রভাবতী দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালে ধাঙড় মেথরদের প্রথম ইউনিয়ন তৈরি হয়।

মেথর, ডোম, হাড়ি, ধাঙড় প্রভৃতি নানা নাম ও পরিচয়ে পরিচিত এই মানুষগুলি শুধু সমাজের নিচুতলাতেই বাস করতেন তাই নয়। তাঁরা অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত হতেন। এরা যে অস্পৃশ্যদের মধ্যেও সবচেয়ে তলায়, তার ইঙ্গিত মেলে জনপ্রিয় প্রবাদে, ''হাড়ির দশা'' বা "যার যেথা মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম।" তনিকা সরকার মনে করেন, গ্রামসমাজে হাড়ি ডোমরা চিরাচরিতভাবে ময়লা সাফাইয়ের কাজ করলেও কলকাতায় ধাঙড়দের একটা বড় অংশ এসেছেন ছোটনাগপুর এলাকার আদিবাসী সমাজ থেকে। তাঁর মন্তব্য, বোধহয় গোড়ায় এঁদের জঙ্গলের গাছ কেটে সাফ করে নগর পত্তনের কাজে লাগাতে ছোটনাগপুর থেকে আনা হয়। পরে এঁরা শহরের শ্রমিক সমাজের একেবারে নীচের তলায় ময়লা সাফাইয়ের কাজে যুক্ত হয়।

১৯২৮ সালে কলকাতায় মেথর ধাঙড়দের ঐতিহাসিক ধর্মঘট হয়। ওই সময়েই দেশে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। পাশাপাশি, মোটামুটি একই সময়ে রেলের খড়গপুর-সহ বিভিন্ন ওয়ার্কশপে এবং চটকলে শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল। শিল্পক্ষেত্রে মন্দার কারণে ছাঁটাই ও কর্মহীনতা শ্রমিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছিল, তারই প্রতিফল ঘটেছিল ওই সব ধর্মঘটে। কিন্তু ধাঙড়দের মোট ১৭ দিনের দুটি ধর্মঘট ঠিক একই কারণে হয়নি।তনিকা সরকার মনে করিয়ে দেন, তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ছিল না। তাঁরা নিজেদের আর্থিক দাবিদাওয়া আদায়ে যে লড়াই করেছিলেন, তা ছিল নিজেদের শ্রমিকশ্রেণির অংশ হিসাবে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই। যে স্বীকৃতি এত দিন শহরের নাগরিক সমাজ এবং প্রশাসন তাঁদের দিতে চাইছিল না। আর এই দাবি যে শুধু কলকাতার ধাঙড়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তারই প্রতিফলন দেখা যায় হরতালের সময়। কলকাতার ধাঙড়দের হরতালের সঙ্গে জুড়ে যায় হাওড়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ এমনকি বোম্বাই ও ভারতের অন্যত্র ঘাঙড়দের ধর্মঘট। সিআরজি ও রোজা লুক্সেমবার্গ স্টিফটুং যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ওই আলোচনা চক্রে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অচিন বানায়ক সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনার নিরিখে শ্রমিকশ্রেণির তত্ত্বগত ধারণাটির ব্যাখ্যা করেন। আইআইএসইআর (মোহালি)র অধ্যাপক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাধীনতার পরে কলকাতায় উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেন। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা পলা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শমিতা সেন, পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় চতুর্বেদী, লেখক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

scavenger right kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE