Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
‘পরাজিত’ আইনরক্ষক

যাদবপুরের বিক্ষোভে মাথা নোয়াল পুলিশই

পুলিশ নিগ্রহে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা বারবারই ছাড় পেয়েছেন। এ বার সেই তালিকায় ঢুকে প়ড়লেন যাদবপুরের পড়ুয়ারাও! তাঁদের বিরুদ্ধেও এক পুলিশ অফিসারকে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

জারি অবস্থান-বিক্ষোভ। রবিবার, যাদবপুর থানার সামনে। — নিজস্ব চিত্র।

জারি অবস্থান-বিক্ষোভ। রবিবার, যাদবপুর থানার সামনে। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদদাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৫ ০২:১৭
Share: Save:

পুলিশ নিগ্রহে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা বারবারই ছাড় পেয়েছেন। এ বার সেই তালিকায় ঢুকে প়ড়লেন যাদবপুরের পড়ুয়ারাও! তাঁদের বিরুদ্ধেও এক পুলিশ অফিসারকে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে পুলিশের বিরুদ্ধে শনিবার রাত থেকে রবিবার বিকেল পর্যন্ত অবস্থান-বিক্ষোভ দেখিয়েছে পড়ুয়াদের একাংশই।

পুলিশ সূত্রে খবর, শনিবার রাত আটটা নাগাদ যাদবপুর থানার পিছন দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন অভিজিৎ সালুই নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তখন রাজকুমার মণ্ডল নামে এক পুলিশ অফিসার ওই পথে থানায় ঢুকছিলেন। তিনি অভিজিৎকে সরে যেতে বলেন। তা নিয়েই দু’জনের বচসা শুরু হয়। অভিযোগ, অভিজিৎ ওই পুলিশ অফিসারকে ধাক্কা দেন ও অশ্লীল মন্তব্য করেন। তার পরে পুলিশ অফিসার ছাত্রটিকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যান। পরে অবশ্য হস্টেল সুপার ও থানার কর্তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটিয়ে দেওয়া হয়।

প্রাথমিক ভাবে বিষয়টি মিটে গেলেও শনিবার গভীর রাত থেকে যাদবপুরের পড়ুয়ারা পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্র নিগ্রহের অভিযোগ তুলে থানার সামনে অবরোধ শুরু করেন। রবিবার বিকেলে যাদবপুর থানার ওসি বিজয়কুমার সিংহ লিখিত ভাবে দুঃখপ্রকাশ করলে অবরোধ তুলে নেন বিক্ষোভকারীরা।

গত সেপ্টেম্বরে তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন পড়ুয়ারা। কিন্তু সূত্রের খবর, এ বার পড়ুয়াদের সমস্যা মেটানোয় উদ্যোগী হন নতুন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘পড়ুয়া ও পুলিশ, দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে মিটমাট করিয়েছি। দু’পক্ষকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’’ ভবিষ্যতেও যে তিনি আলোচনার পথেই সমস্যা মেটাবেন, সে কথাও জানান উপাচার্য। সুরঞ্জনবাবুর এই ভূমিকার প্রশংসা করেছেন ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকেই।

ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছে, এই বিক্ষোভের যৌক্তিকতা নিয়ে। যাদবপুরের ছাত্র সংগঠন ফেটসু-র সভাপতি শুভব্রত দত্তের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘থানা চত্বরে ঢুকে যে কেউ চা খেতেই পারে। পুলিশ আপত্তি করবে কেন?’’ শুভব্রতর মন্তব্যে অবাক যাদবপুরের অনেক প্রাক্তনী। তাঁদের বক্তব্য, থানায় ঢুকে চা খেলে পুলিশ আপত্তি করতেই পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে নিগ্রহ করা কোন আইনে সিদ্ধ? পুলিশকে নিগ্রহের পরেও ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে যাদবপুর থানা আইনি ব্যবস্থা নিল না কেন, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই। লালবাজারের একাংশ বলছে, ওই প়ড়ুয়াদের অন্যায্য দাবির সামনে দুঃখপ্রকাশ করে কার্যত দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন পুলিশকর্তারা।

যাদবপুর থানার দাবি, ওই ছাত্র বিষয়টি মিটমাট করে নিতে চাওয়ায় মামলা করেননি ওই পুলিশ অফিসার। মামলা করলে ছাত্রের ভবিষ্যত নষ্ট হতে পারত। তা ছাড়া, ওই ছাত্র এবং হস্টেলের সুপার এসে দুঃখপ্রকাশ করায় বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করা হয়নি। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুব রহমান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’

এ দিনই থানার মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজকুমার মণ্ডল নামে ওই এসআই। তাঁকে প্রথমে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় সন্ধ্যায় তাঁকে একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই আইসিইউ-তে ভর্তি আছেন তিনি।

পুলিশ সূত্রের খবর, এই গোটা বিক্ষোভের পিছনে অন্য ধরনের সমীকরণ রয়েছে। থানায় যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে অভিযোগকারী হিসেবে অভিজিৎ সালুইয়ের নাম নেই। অভিযোগ হয়েছে ‘যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী’-দের তরফে। কারা এই ছাত্র? পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলছেন, অভিযোগকারী ও বিক্ষোভের নেতৃত্বে থাকা মুখগুলিকে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের প্রথম সারিতে দেখা গিয়েছিল।

পড়ুয়াদের একাংশ বলছেন, শনিবার রাতেই বিক্ষোভ তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে যাদবপুর থানার অতিরিক্ত ওসি দেবাশিস দত্ত দফায় দফায় অবস্থানকারীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু কিছু পড়ুয়া ইচ্ছে করেই বিক্ষোভ চালানোর উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিলেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এই বিষয় নিয়ে নানা রটনাও চলছিল। রবিবার যাদবপুরের কলা বিভাগের এক পড়ুয়া বলেন, ‘‘অভিজিতের সঙ্গে কী হয়েছে, জানি না। যাদবপুর আন্দোলনে নেমেছে শুনেই চলে এসেছি।’’

এ দিন সকালে বিক্ষোভকারীদের কাছে আসেন ডিন অব স্টুডেন্টস রজত রায়। কিন্তু তাঁর কথা শোনেননি পড়ুয়ারা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে যান ডিসি (সাউথ সাবার্বন) সন্তোষ পাণ্ডে এবং যাদবপুর থানার ওসি বিজয়কুমার সিংহ। তাঁদেরও কার্যত অপমান করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের একাংশ বলছেন, যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ঘেরাওমুক্ত করতে গিয়ে লাঠি চালিয়েছিল পুলিশ। তা থেকেই শুরু হয় ‘হোক কলরব’। তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়ে কিছুটা ভীতিও কাজ করে পুলিশের অন্দরে। ‘‘তার ফলে ওরা হাজার দোষ করলেও ছাড় পেয়ে যায়,’’ বলছেন এক সাব-ইনস্পেক্টর। এই প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে বছর দেড়েক আগের একটি ঘটনা। ট্রাফিক আইন ভেঙে ভ্যানরিকশাভর্তি বাজার নিয়ে হস্টেলে ঢুকছিলেন কয়েক জন পড়ুয়া। সে বারও এক সার্জেন্ট তা নিয়ে আপত্তি করেন। সে বারও এমন গোলমাল শুরু হয়েছিল। লিখিত ভাবে দুঃখপ্রকাশ না করলেও আইনরক্ষার ‘অপরাধে’ ওই সার্জেন্টকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল।

এই অবস্থান-বিক্ষোভ নিয়ে পুলিশ ‘নমনীয়’ মনোভাব দেখালেও যাদবপুরের প়়ড়ুয়ারা অবশ্য ফের আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য মেলেনি, এই ধুয়ো তুলে তাঁরা জানান, আজ, সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জমায়েত করবেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE