রাসবিহারী মোড়। —ফাইল চিত্র।
আমি কলকাতায় আছি প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালি অঞ্চলে থাকতে থাকতে আমার চোখের সামনেই শহরটা বদলে গিয়েছে একটু একটু করে। সেই বদল যেমন কলকাতার মননে হয়েছে, তেমনই আঙ্গিকেও হয়েছে। বাম জমানায় কলকাতা ছিল এক রকম। আর তার পরে গত ১০-১১ বছরে, তৃণমূলের সময়ে এই শহরটা যেন আবার অন্য দিকে বাঁক নিয়েছে!
আমার ছোটবেলার কলকাতায় এমন উড়ালপুল ছিল না। এত আলো ছিল না। ছিল কালো-হলুদ ট্যাক্সি, রুপোলি রঙের বেসরকারি বাস আর এক দিকে হেলে পড়া ডবল ডেকার। আমাদের বাড়ির কাছের রবীন্দ্র সরোবরে চলত টয় ট্রেন। স্টেশনটার নামও মনে আছে। স্বপ্নপুরী! একটা বড় রাক্ষসের মুখের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে হত সেই স্টেশনে। মনে হত, স্বপ্নপুরীতে যাওয়ার প্রবেশপথে রাক্ষসের মুখ কেন? সেই ছোটবেলায় না বুঝলেও এখন বুঝি, সব স্বপ্নপুরীর কাছে যেতে হলেই রাক্ষসের মুখের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় আমাদের!
সেই সময়ে কলকাতায় রাস্তার মাঝে ঘাসে মোড়া আইল্যান্ড ছিল। তার মধ্যে দিয়ে ট্রাম চলত। গড়িয়াহাটে বুলেভার্ড ছিল। আর ছিল অনেক পুরনো, সুন্দর, সামনে ছোট্ট উঠোন বা বাগান দেওয়া বাড়ি!
বয়স হয়ে গেলে ছোটবেলার সব কিছুই বোধহয় ভাল লাগে। তাই পুরনো সময়ে কী ছিল বা ছিল না, সেই নিয়ে শব্দ খরচ না করে এখন কেমন আছি সেটা দেখা যাক।
আমাদের এই মুদিয়ালি অঞ্চলটা বেশ ফাঁকা আর সুন্দর। চওড়া রাস্তাগুলো পরিষ্কার থাকে সব সময়ে। গাছপালাও বেশ রয়েছে। আর সব চেয়ে আনন্দের বিষয় হল, নতুন গাছও পোঁতা হয় নিয়ম করে। পাড়ায় জমাদার আসেন ঠিক মতো। যাঁরা ময়লা নিতে আসেন, তাঁরাও সকাল সকাল এসে বেল বাজিয়ে ময়লা তুলে নিয়ে যান। রাস্তায় ঝাঁট পড়ে দু’-তিন বার। জলের সমস্যা নেই। এমনকি, খুব বৃষ্টি হলে কিছু জায়গায় সামান্য জল জমলেও বৃষ্টি কমার কিছু ক্ষণের মধ্যেই নেমে যায় সেই জল! সেই নব্বইয়ের দশকের শেষের মতো সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কিছু জায়গায় নৌকা চলার মতো অবস্থা তৈরি হয় না!
আর একটা ব্যাপার হল, এখানে বিদ্যুৎ বা জলের কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়া হলে খুব দ্রুত সেই রাস্তা মেরামত করে দেওয়া হয়। আশপাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রও হয়েছে কয়েকটা। আর্থিক ভাবে যাঁদের কিছু সমস্যা রয়েছে, তাঁরাও চিকিৎসা করাতে পারেন সেখানে। আগে যে সব পার্ক ময়লা আর জঙ্গুলে হয়ে পড়ে থাকত, সেগুলো এখন ঝকঝকে। অনেক পার্কেই বাচ্চাদের জন্য দোলনা, স্লিপ ইত্যাদি বসেছে। আর তাতে ভিড়ও হয় বেশ। পুজোর মুখে ফুটপাত সারানো হয়। রং করা হয়। আলোও লাগানো হয়েছে প্রচুর। আমাদের দক্ষিণ কলকাতার এই অংশের মানুষজন মোটের উপরে খুশিই সমস্ত পরিষেবা পেয়ে।
তবে আমি নিজে যে হেতু খুব হেঁটে ঘুরে বেড়াই, তাই দু’-একটা জিনিস নিয়ে আমার খারাপ লাগা রয়েছে। যেমন ফুটপাত। রাসবিহারী মোড় থেকে সাদার্ন অ্যাভিনিউ অবধি যে ফুটপাত রয়েছে, সেটা আর হাঁটার যোগ্য নেই। সেখানে প্রচুর মানুষ বসবাস করেন। সেখানেই তাঁরা ঘুমোন, রান্না করেন। সেখানেই ফুটপাত আটকে বসে থাকেন। আরও সব নানা কাণ্ডকারখানা চলে। ফুটপাতটা একদম নোংরা হয়ে থাকে। এতে আমার মতো সাধারণ মানুষজন, যারা লাল-নীল বাতির গাড়ি চড়ে ঘুরি না, হেঁটেই ঘুরি, তাদের খুবই অসুবিধা হয়। আর আমার মনে হয়, শুধু পথচারীদের অসুবিধাই নয়, ওই ভাবে যাঁরা ঝড়-জল-বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থাকেন, তাঁদেরও তো কম কষ্ট হয় না বা কম খারাপ লাগে না। এই মানুষগুলোকে যদি পুনর্বাসন দেওয়া যায়, তা হলে এঁদেরও মাথার উপরে একটা ছাদ হবে আর ফুটপাতটাও পথচারীদের জন্য আবার ফিরে পাওয়া যাবে।
ফুটপাতের আর একটা সমস্যা হল উপচে ওঠা হকার। রাসবিহারী থেকে লেক মার্কেট অবধি ফুটপাত, বিশেষ করে ডান দিকের ফুটপাতে তো হাঁটাই দায়। আমি জানি না মানুষজনের রুজিতে হাত না দিয়ে, সবার যাতে সুবিধা হয়, সেই রকম ব্যবস্থা কী ভাবে করা যাবে। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু করা খুবই দরকার। কারণ ফুটপাত ছেড়ে পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
ভাল-খারাপ মিলিয়েই জীবন। প্যারিস বা রোমের রাস্তাতেও হোমলেসদের দেখেছি আমি। কিন্ত তাই বলে কলকাতাতেও সেটা থাকলে অসুবিধা নেই, তা তো নয়। তাই আমার শহরের প্রিয় এই অংশের মধ্যেকার এই কয়েকটা ক্ষতের যদি নিরাময় করা যায়, তা হলে আমাদের শহর আর জীবনযাপন সুখের ও আনন্দের হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy