Advertisement
E-Paper

স্মৃতির মতোই বেঁচে আছে রিঙ্কুর ‘তাসের ঘর’

এনার মনে আছে, রিঙ্কুকাকু ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন শুটিংয়ে। মুখও ধুতে দেননি। প্রসাধন শিল্পীর মেক-আপ পছন্দ হয়নি। নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন এনাকে। 

স্যমন্তক ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৮ ০২:০৩
ইন্দ্রাণী পার্কে ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়ি। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

ইন্দ্রাণী পার্কে ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়ি। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

‘তাসের ঘর’ সব সময়ে ভেঙে পড়ে না। রং বদলায়।

পাঁচ বছর ধরে ক্রমশ জীর্ণ হতে থাকা ক্রিম-সাদা বাড়িটা হঠাৎ লাল হয়ে গিয়েছে। মাসখানেক আগে। এক পরিচালকের নতুন ছবির শুটিংয়ের দৌলতে। আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ খড়খড়ির জানলা চুঁইয়ে পশ্চিমের রোদ ঢোকার উপায় নেই। একেবারেই কি নেই? দোতলার গোল বারান্দা-ঘেঁষা একটা পাল্লা অনিচ্ছায় খোলা।

বারান্দা লাগোয়া কাঠচাঁপা গাছ সে দিকেই মুখ ফিরিয়ে। আর রাস্তায় ঝরে পড়া ফুলের উপরে কাঠের তক্তা আর রবারের বল নিয়ে নাগাড়ে পিটিয়ে চলেছে রবি। বছর দশেকের বালক ঋতুপর্ণ ঘোষকে দেখেনি। শুধু জানে, বছর পাঁচেক আগে এমনই এক পশ্চিমের মনভেজানো দিনে দোতলার কাচের জানলাওয়ালা ঘরটায় ঘুমের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন তিনি। তার কয়েক মাস পরেই এ বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠাঁই হবে রবির।

নতুন কেয়ারটেকার।

উল্টো পিঠের বাড়ির বারান্দায় বসে রোদমাখা ‘তাসের ঘর’-এর দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্মৃতিরেখা। ঋতুপর্ণের পাড়াতুতো বউদি। ওই বাড়িতেই তো ‘রেনকোট’, ‘তিতলি’র শুটিং করেছিলেন তাঁদের রিঙ্কু। বরাবরই রিঙ্কুদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন স্মৃতিরেখা। বিশেষ করে দুপুরের দিকে। চার দিক যখন নিস্তব্ধ। সামনের ছোট্ট পুকুরে উড়ে এসে জুড়ে বসে পানকৌড়ির দল।

রিঙ্কুর সঙ্গে বারান্দায় বারান্দায় কথা হত স্মৃতিরেখার। দোতলার গোল বারান্দায় সাদা গাউনে পায়চারি করতেন রিঙ্কু। বউদির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তেন। কুশল বিনিময় হত। ২০১৩-র ২৯ মে রাতেও তো হয়েছিল। রাতে চালক গোবিন্দ এসে গাড়ি রেখেছিলেন কালো দরজার সামনে। কেয়ারটেকার দিলীপ দরজা খোলার আগে চোখাচোখি হয়েছিল দু’জনের। হাত নেড়ে কুশল বিনিময় হয়েছিল। ‘‘কে জানত, পরদিন মর্নিং ওয়াক সেরে ঘরে ঢোকার সময়ে শুনতে হবে খবরটা! ঠিক এমনই দেখতে লাগছিল ঘরটা! পর্দা সরানো ছিল জানলার ওপারে।’’ চোখ মুছলেন স্মৃতিরেখা। পাঁচ বছর আগে ঠিক এ ভাবেই পশ্চিমের রোদে ভিজেছিল বাড়িটা। স্ট্রেচারে রিঙ্কুর দেহ বার করেছিলেন তামাম সেলিব্রিটিরা। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল পানকৌড়ির দল।

গোবিন্দ এখন অন্যত্র চাকরি করেন। নেই দিলীপও। হারিয়ে গিয়েছেন সর্বক্ষণের সাহায্যকারী ছবি।

ঋতুপর্ণের মৃত্যুর পরে নতুন কেয়ারটেকার গৌরাঙ্গ হালদার এসেছেন। রবি তাঁরই পুত্র। কথার ফাঁকে ফ্লুরোসেন্ট সবুজ জার্সি গায়ে বেরিয়ে পড়ল ফুটবল ক্লাসের জন্য। ‘তাসের ঘর’ আরও নিঝুম হল।

নিস্তব্ধতা ভাঙলেন স্মৃতিরেখার মেয়ে এনা। ঋতুপর্ণের অসমাপ্ত তথ্যচিত্র ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথের অসুস্থ মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এনার মনে আছে, রিঙ্কুকাকু ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন শুটিংয়ে। মুখও ধুতে দেননি। প্রসাধন শিল্পীর মেক-আপ পছন্দ হয়নি। নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন এনাকে।

পুরো বাড়িটাই নিজে সাজাতেন রিঙ্কু। ঠিক যে ভাবে সাজাতেন তাঁর মা। স্মৃতিরেখার মনে পড়ল আশির দশকের কথা। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরত দু’ভাই। রিঙ্কু বরাবর শান্ত। মা দাঁড়িয়ে থাকতেন গোল বারান্দায়। দেখতেন দু’জনের স্কুলের খাতা। এর অনেক পরে ওই বারান্দাতেই ঐশ্বর্যা রাই, শর্মিলা ঠাকুরদের দেখবেন স্মৃতিরেখা। রিঙ্কুর কাছে আবদার করে আলাপ করবেন।

রিঙ্কু নেই। ‘তাসের ঘর’ও একলা। জ্বলে না ঝাড়বাতি। দোতলার দরজার রং চটে তিরচিহ্নের চেহারা নিয়েছে। মনখারাপের দুপুরে স্মৃতিরেখার স্মৃতিতে এক বছর আগের এক ছবি। সে দিন ঋতুপর্ণের বন্ধুরা এসেছিলেন। কিন্তু তালা খোলার লোক ছিল না। দরজার বাইরে পেরেক ঠুকে মালা ঝুলিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। পাঁচ বছর পরে মালা দিতেও আসেননি কেউ। রিঙ্কুর প্রিয় কাঠচাঁপা গাছটাই কেবল স্মৃতির তাসের ঘরে ফুলের গালিচা বানিয়ে রেখেছে।

পশ্চিমের রোদ ফিকে হল।

Rituparno Ghosh Director Actor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy