Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Kolkata Metro

এ শহর ভালবাসা জানাতে দেয় না

দু’জন মানুষ কোথায় কী করবে তা নিয়ে আমাদের তৈরি করা ‘সমাজ’-এর চিরকালের মাথাব্যথা। শুধু মাথাব্যথা বলেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়? একটু তলিয়ে দেখার সময় এখন।

এ শহর প্রেম জানে না। কাউকে চুমু তো দূর, জড়িয়ে ধরতে দেখলেই ঈর্ষায় গর্জে ওঠে। আর পাশে আরও চারটি তার মতো বাবু পেলে হাত চালাতেও দ্বিধা করে না!  গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এ শহর প্রেম জানে না। কাউকে চুমু তো দূর, জড়িয়ে ধরতে দেখলেই ঈর্ষায় গর্জে ওঠে। আর পাশে আরও চারটি তার মতো বাবু পেলে হাত চালাতেও দ্বিধা করে না! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৮ ১৪:৪৪
Share: Save:

কোন দিক থেকে শুরু করব? বাঙালি? ভারতীয়? নগর, রাষ্ট্র? কে টুঁটি চেপে ধরবে ভালবাসার মুখ? ওদের ভালবাসতে দেব না!

দু’জন মানুষ কোথায় কী করবে তা নিয়ে আমাদের তৈরি করা ‘সমাজ’-এর চিরকালের মাথাব্যথা। শুধু মাথাব্যথা বলেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়? একটু তলিয়ে দেখার সময় এখন। এই প্রেম- ভালবাসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষমতায়নের লাভ-ক্ষতির খেলা। কোনও একটা মাধ্যম ধরে বললে, বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।

সিনেমায় তো কত বার দেখেছি আমরা, দুই বাড়ির শিল্পপতির লড়াই। এ বাড়ির মেয়ে ও বাড়ির ছেলের প্রেমে পড়েছে। ব্যস, সেই নিয়ে ছবিতে ধুন্ধুমার। মানে প্রেমে পড়া থেকেই বাধার শুরু। আর ভালবাসার উপর, আলিঙ্গনের উপর আরও বড় নিয়ম খাড়া করা হয়েছে সেই আদিকাল থেকে। বাঙালি সমাজ এই আদ্যিকালের প্রোডাক্ট। তারা ভদ্র বাবু। প্রেমের কবিতা আউড়ে প্রেয়সীর প্রেম উস্কে দেয়। হোয়াটস্অ্যাপে সুড়সুড়ি পাঠায়, ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকে চাই’। তারপর নিজেরা সাবধান হয়। এর বেশি এগোলে যদি বউ রেগে যায়! সংসারের সারমর্ম হারিয়ে যাবে তো! তাঁর চেয়ে বরং একটু আধটু…কিন্তু অন্য কাউকে চুমু তো দূর, জড়িয়ে ধরতে দেখলেই ঈর্ষায় গর্জে ওঠে। আর পাশে আরও চারটি তার মতো বাবু পেলে হাত চালাতেও দ্বিধা করে না! আমরা চেপেছি তোরাও চাপ! এ শহর অনেকের অনেক কিছু জানলেও ভালবাসাকে খুব একটা বেশি জানতে দিচ্ছে না!

আরও পড়ুন:

‘হোক আলিঙ্গন’, মেট্রো স্টেশনেই অভিনব প্রতিবাদে সামিল শহর

প্রকাশ্যে যৌনাঙ্গ ব্যবহার করে মূত্রত্যাগ অপরাধ নয়, আলিঙ্গনেই দোষ?

আসলে বাঙালির যত কামনা তোলা থাকে বিছানায়। সেই বিছানার বিশেষ প্রোডাক্ট এক শিশু যদি ধরাধামে অবতীর্ণ হয় তো ব্যস! প্রেমের ইতি! অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরাতে হবে এ বার।

অবদমনের সেই শুরু! প্রেমহীন, উস্কানি সর্বস্ব, ধরি নারী না ছুঁই দেহ রসায়ন! নাকি অবদমন?

সোমবার মেট্রোতে নিগৃহীত তরুণ-তরুণীর পাশে দঁড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল গোটা শহরের মানুষ। দেখুন ভিডিয়ো:

এক পরিচিত অধ্যাপিকা পঞ্চাশের জন্মদিনে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে বাৎস্যায়ন পড়তে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর ভালবাসাকে এক অন্য চেহারা দিতে এই পরিকল্পনে করেছিলেন। আর সেখানেই কাল হল। মায়েদের কাম বাসনা? ছি! মা-বাবা পবিত্র। বাঙালি শিশু, ভারতের সংস্কারের শিশুরা যেন বাবা-মাকে বিশেষ ঘনিষ্ঠতায় না দেখে! মনের ওপর চাপ পড়বে!

চাপ নিশ্চয়ই পড়ে, কিন্তু তার ফল তো বড় হয়ে যৌন অত্যাচার, সুড়সুড়ি বা আরও এগিয়ে বললে ধর্ষণ! যা কিছু স্বাভাবিক তাকেই আটকাই আমরা!

কথায় কথায় পুরী যাওয়া আমাদের অভ্যেস। ভুড়ি বাগিয়ে খালি গায়ে সমুদ্র রোম্যান্স, সঙ্গে হাতকাটা ম্যাক্সির বউ বা পরের বউ, কম খরচে চোখের দেখায় বাসনার শান্তিজল। খুব ভাল কথা! পুরী থেকে একটু এগিয়েই তো কোনারক। সেখানে তো যাবই আমি যাবই। ছেলেকে বউয়ের জিম্মায় দিয়ে মূর্তিগুলো গোগ্রাসে গিলব! ব্যস!

মন্দিরের গায়ে এই মূর্তি! ভাবলাম না তো, কেন?

যদি কোনারক ধরি, দেখব সেখানে আঁকা ইতিহাসের গন্ধে, বর্ণে শৃঙ্গারের শুদ্ধতা। সেখানে সকল মানুষের রতিবাসনা প্রকাশের কথা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তা হলে, প্রেম বা তার প্রকাশ নিয়ে মন্দিরের দেহে কোনও বারণ নেই, গ্লানি নেই, ক্ষোভ নেই। বাঙালির আছে। ভারতবর্ষের আছে।

বিষয়টা কী দাঁড়াল?

আজ তা হলে ক্রমশ আমরা পিছিয়ে গেলাম। আধুনিকতা, উদারতা সব মিথ্যের মুখোশ! হ্যাঁ, সতীদাহ নেই! মেয়েদের পড়াশোনায় মন দিতে বলা হচ্ছে। বিধবারা বিয়ে করতে পারছেন! বাহ! কিন্তু উল্টো দিকে এ কী! মেট্রোয় যুবক-যুবতী কাছে এলেই জেগে উঠবে অবদমিত কাম! থুরি স্বর! একেবারে গায়ে হাত! জোর যার মুলুক তার।

বাঙালির কাছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক মানেই সেক্স! আমরাই আবার প্রেমিক-প্রেমিকার লোকসম্মুখে হাত ধরা বা চুমু খাওয়া সাপোর্ট করি না! কি হিপোক্রেসি রে ভাই!

অকপটে ভালবাসার চাহিদার কথা বলার সময় এখনও আসেনি, এই দেশে, এই একবিংশ শতকেও। পুরুষই খোলাখুলি সে কথা বলতে পারে না তো নারী! ভালবাসার প্রকাশ নিয়ে কথা বা আলোচনা এত দিনেও প্রাত্যহিক হয়ে ওঠেনি। আর তাই ভালবাসা, শরীরের চাওয়া, আকাঙ্খাও অন্তরালে রয়ে গিয়েছে— সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে। এখনও, এ কালেও। সমস্ত কিছুর দমনের বহিঃপ্রকাশ তো ভুল রাস্তা নেবেই। বড্ড বেশি ভুল!

দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মাঝে ভাল বোঝাপড়া থাকলেই ঘনিষ্ঠ মহলে কানাকানি শুরু হয়ে যায়! সব তো শরীরের চাহিদা, রাতে নিশ্চয়ই! কোনও দিন! যেন যা হবে সব রাতেই!

রাজনীতি, গণতন্ত্র যে যা-ই বলি না কেন, চরাচরে নীতি একটাই— আমি পাবো না তো ওকেও দেব না! বা আমি যা পাইনি ও যেন কক্ষনও না পায়!

আমরা বরং সব মুছে দিয়ে বলি, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE