Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মদ্যপানের প্রতিবাদে পাল্টা মার পুলিশকেই

রাতে টহলদারির সময়ে চিৎপুর থানার অতিরিক্ত ওসি শচীন মণ্ডল দেখেন, সর্বমঙ্গলা ঘাটে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করছে কয়েক জন যুবক। শচীনবাবু তার প্রতিবাদ করায় দল বেঁধে তেড়ে আসে ওই যুবকেরা।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৪৮
Share: Save:

প্রতিবাদ করতে গেলে সাধারণ মানুষ তো বটেই, খোদ আইনরক্ষকেরাও যে আজকাল আর নিরাপদ নন, শহর ও শহরতলির একের পর এক ঘটনা বারবার সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে! যার সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার রাতে, সর্বমঙ্গলা ঘাটে।

পুলিশ জানিয়েছে, ওই রাতে টহলদারির সময়ে চিৎপুর থানার অতিরিক্ত ওসি শচীন মণ্ডল দেখেন, সর্বমঙ্গলা ঘাটে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করছে কয়েক জন যুবক। শচীনবাবু তার প্রতিবাদ করায় দল বেঁধে তেড়ে আসে ওই যুবকেরা। বিয়ারের বোতল, ইট আর লাঠি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই অফিসারের উপরে। বেধড়ক মারের চোটে মাথা ফেটে যায় শচীনবাবুর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, প্রাণভয়ে রক্তাক্ত অবস্থাতেই কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল কারখানার সামনে দিয়ে রীতিমতো দৌড়তে থাকেন শচীনবাবু। গভীর ক্ষত নিয়ে একবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন তিনি।

এই ঘটনার পরে অবশ্য চিৎপুর-সহ এলাকার একাধিক থানার বাহিনী নিয়ে ন’জনকে পাকড়াও করেছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশেরই একাংশের প্রশ্ন, ওই এলাকায় দুষ্কৃতীদের উপদ্রব তো নতুন নয়। তা হলে এত দিন কিছু বলা হয়নি কেন? খোদ স্থানীয় বিধায়ক মালা সাহাও দাবি করেছেন, ওই এলাকায় বহিরাগতদের যাতায়াত রয়েছে। কেউ কেউ আবার এই ঘটনার কথা শুনে তিন বছর আগের গোপাল তিওয়ারির প্রসঙ্গ মনে করিয়েছেন। একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও মাফিয়া ডন গোপালের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি লালবাজার। পুরসভার ভোটে এক পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে টনক নড়েছিল উর্দিধারীদের। এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তার আক্ষেপ, ‘‘উর্দির গায়ে আঁচ না লাগলে কি দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? এ ভাবে কত দিন চলতে পারে?’’

মার্চেই ছয়ে ছয়

• ৩০ মার্চ: জ্যোতিনগর কলোনিতে আক্রান্ত অতিরিক্ত ওসি

• ২৬ মার্চ: তপসিয়ায় বেপরোয়া দুই মোটরবাইক আরোহীর হাতে আক্রান্ত কনস্টেবল

• ১৯ মার্চ: নাদিয়াল থানার ভিতরে আক্রান্ত পুলিশ অফিসার

• ১৯ মার্চ: পার্ক সার্কাসে মোটরবাইক আরোহীর হাতে আক্রান্ত ট্র্যাফিক সার্জেন্ট

• ১৩ মার্চ: বেনিয়াপুকুরে প্রহৃত সার্জেন্ট

• ২ মার্চ: ট্যাংরায় উত্তেজিত জনতার হাতে আক্রান্ত একাধিক পুলিশ অফিসার

পুলিশ সূত্রের খবর, ওই এলাকা উত্তর বন্দর থানার আওতায়। শচীনবাবুকে মারধরের ঘটনায় যারা অভিযুক্ত, তারা প্রত্যেকেই তৃণমূল সমর্থক বলে এলাকায় পরিচিত। স্থানীয় কাউন্সিলর সুমন সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চিৎপুর থানায় ফোন করে অভিযুক্তদের ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ অফিসারেরা তাতে রাজি হননি। থানায় ফোন করার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সুমনদেবীও। তাঁর সাফাই, ‘‘দু’জন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকেও পুলিশ ভুল করে পাক়়ড়াও করেছিল। তারা ঘটনায় জড়িত নয়। তাদের ছেড়ে দিতেই অনুরোধ করেছিলাম।’’ যদিও কে জড়িত এবং কে জড়িত নয়, তা ওই রাতেই সুমনদেবী কী ভাবে জানলেন, তার সদুত্তর মেলেনি। ঘটনাস্থল বা থানা, কোথাও তিনি যাননি।

সর্বমঙ্গলা ঘাটে পড়ে গাঁজার কল্কে।

কী ঘটেছিল শুক্রবার রাতে?

পুলিশ সূত্রে খবর, রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ দেহরক্ষী ও চালককে নিয়ে সর্বমঙ্গলা ঘাট এলাকায় টহল দিচ্ছিলেন শচীনবাবু। তখন তিনি দেখেন, মুফতি নামে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী-সহ কয়েক জন গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে মদ খাচ্ছে। তিনি ওই যুবকদের সরে যেতে বলেন। সে সময়ে জোয়ার এসে গিয়েছিল। জলস্তর বে়ড়ে গেলে ওই যুবকেরা বিপদে পড়তে পারত। প্রথমে সরে গেলেও শচীনবাবু যখন ফিরছেন, তখন পিছন থেকে হামলা চালায় ওই যুবকেরা। শচীনবাবুর গাড়িচালক কোনও মতে থানায় ফোন করেন। কিছু ক্ষণ পরেই বিরাট বাহিনী গিয়ে সর্বমঙ্গলা ঘাট সংলগ্ন জ্যোতিনগর বস্তি ঘিরে ফেলে ন’জনকে পাক়ড়াও করে। পুলিশেরই একাংশ জানাচ্ছে, কয়েক দশক আগে ওই বস্তি গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরেই ওই বস্তিকে কেন্দ্র করে চুরি, ছিনতাই, মাদকের কারবার চলছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই করত না।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন এলাকাবাসীরা।

শনিবার দুপুরে সর্বমঙ্গলা ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, একটু দূরে দূরে বেশ কয়েকটি জটলা। পুলিশের মার খাওয়া নিয়েই আলোচনা চলছে। স্থানীয় একটি কিয়স্কে সিঁটিয়ে বসে এক পুলিশকর্মী। অভিযোগ, পুলিশ এসে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই লাঠিপেটা করেছে। ভোর তিনটে পর্যন্ত তাণ্ডব চলেছে। নাসিফা বিবি নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘আমরা ঘুমোচ্ছিলাম। দরজা ভেঙে পুলিশ ঘরে ঢুকে মারধর শুরু করে। মহিলা পুলিশও আনা হয়নি।’’ স্থানীয়দের একাংশের এ-ও অভিযোগ, ঘাটের কাছে পুলিশ কিয়স্কে কোনও কর্মী থাকেন না। পুলিশও ঘাটে মদ খায়। যদিও পুলিশ কর্তারা এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

চিৎপুর থানার অতিরিক্ত ওসি শচীন মণ্ডল।

স্থানীয় এবং পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শাহদাত, মুসা, হাফিজুরের মতো শাসক দল ঘনিষ্ঠ দুষ্কৃতীরাই ওই বস্তি নিয়ন্ত্রণ করে। থানার কাছেও সে সব খবর ছিল। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর সুমন সিংহ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিধায়ক মালাদেবী অবশ্য বলেন, ‘‘অভিযুক্তেরা তৃণমূল করুক বা না-ই করুক, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

কিন্তু শহরবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, উর্দিতে হাত পড়লে তবেই তোলপা়ড় হয়! তা-ও দিন কতক। তার পরে ফিরে আসে পুরনো ছবিটাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE