যুগল: কাছাকাছি। প্রিন্সেপ ঘাটে, বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
কিছু ঘটনা পরপর ঘটবেই। ‘ময়দানে যেই মেটাবে ঠোঁটের জ্বালা, বাগড়া দেবেই বেরসিক ফেরিওয়ালা’— আড়াই দশক আগের বাংলা গানেই ধরা পড়েছিল এই ক্রম পরম্পরা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রিন্সেপ ঘাটে অনুমতি নিয়ে যে যুগলের সঙ্গে কথা হল, তাঁরা বলছিলেন, এই ২০১৮-তেও অভিজ্ঞতাটা পাল্টায়নি। অফিস ছুটি নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে গঙ্গার ধারে বসেছেন তরুণ। তরুণী কলেজের তৃতীয় বর্ষ। মেয়েটি হাসতে হাসতেই বলছিলেন, ‘‘হঠাৎ লেবু চা নিয়ে পার্কে ঢুকে পড়া ফেরিওয়ালা বা উটকো ভিখারিরা অপ্রস্তুতে ফেললেও তত রাগ হয় না। ওঁরাও তো পেটের দায়ে ঘুরঘুর করছেন। আমরা এখন অভ্যস্ত।’’
দমদম মেট্রো স্টেশনে ‘ঘনিষ্ঠতা’র অপরাধে যুগলকে গণপিটুনির অভিযোগে তুলকালাম বাধার পরে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। গণপরিসর বা ‘পাবলিক স্পেস’-এ কতটা নিরাপদ শহরের যুগলেরা? ফেরিওয়ালা-ভিখারির ‘উপদ্রব’ ছাড়াও মাত্রাছাড়া কৌতূহল বা ‘নীতি-পুলিশগিরি’ কতটা বিপজ্জনক তাঁদের জন্য? কিংবা বাস-মেট্রো-পার্ক-রেস্তরাঁ-শপিং মলে কত দূর ঘনিষ্ঠতার মাত্রা সহনীয় বা আইনসিদ্ধ? নির্দিষ্ট উত্তর নেই কোনও। তবে শহরের প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অনেকের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও যুগলদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নন্দন-চত্বর, গঙ্গার ঘাট বা ইডেনের বাগান থেকে ঘনিষ্ঠতার অপরাধে যুগলদের উপরে পুলিশি হয়রানিরও অভিযোগ ওঠে। কলকাতা পুলিশের আইনে ‘ডিসঅর্ডারলি কনডাক্ট’-এর আওতায় একদা রাস্তায় টলতে টলতে গোলমাল করা মাতাল বা পার্কে চুম্বনরত যুগলের ফারাক থাকত না। বিশৃঙ্খল আচরণের অভিযোগে যুগলদেরও জরিমানা করা হয়েছে। যা কখনও তোলাবাজির নামান্তর হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। কলকাতা পুলিশের এক প্রবীণ অফিসারের কথায়, ‘‘নন্দনে যুগলদের বিরক্ত করার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক বার পুলিশকে বকুনি দিয়েছিলেন। ক্রমশ উত্ত্যক্তকারীদের হাত থেকে যুগলদের রক্ষার দিকটাও পুলিশের মাথায় আসে!’’
আইনত, যুগলদের ঘনিষ্ঠতা যে অপরাধ হতে পারে না, তা কিন্তু স্পষ্ট করেই বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। একেলে বুলিতে, এই প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা হল পিডিএ বা ‘পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন’। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ নম্বর ধারা বলছে, অন্যের বিরক্তির উদ্রেক করে গণপরিসরে অশালীন আচরণ করাটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তিন মাসের জেল, সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে দোষীদের। হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই অশালীন আচরণের কোনও সংজ্ঞা নেই। দু’জনের ইচ্ছেয় চুমু খাওয়া বা জড়িয়ে ধরাকে অশ্লীল বলা যাবে না।’’ শ্লীল-অশ্লীলের মাপকাঠি যুগে যুগে পাল্টায়। ‘‘বিষয়টি কোর্টের বিচারকদের বিশ্লেষণের উপরে নির্ভরশীল,’’ বলছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা সমীর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁরও মত, ‘‘সারা দুনিয়ার নানা ধরনের আচরণের প্রভাব কাজ করছে যুগলদের উপরে। অনেক কিছু ক্রমশ চোখে লাগে না।’’ আজকের কলকাতায় পর্দা ঢাকা কেবিন টিমটিম করছে। তবে শপিং মল, কফিশপ যুগলদের আচরণ নিয়ে খানিক উদার। পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁর ম্যানেজারের কথায়, ‘‘দোতলায় যুগলেরা অনেক সময়ে ঘনিষ্ঠ হন। সচরাচর মাথা ঘামাই না।’’
ষাটের দশকের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পটি বাড়ির অভাবে একত্র থাকতে না পারা এক দম্পতির গোপনীয়তার জন্য হা-হুতাশ তুলে ধরেছিল। নিষ্ঠুর এই কলকাতার রাজপথ, ভিড় বাস, এমনকি ময়দানের ঘোড়ার গাড়িতেও একটু কাছে এলেই তাঁদের বরাদ্দ ছিল শুধুই টিটকিরি, অপমান। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে এই সে দিনও যুগলদের উদ্দেশেই লেখা ছিল, ছাতা খুলে বসবেন না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানের কর্তা জয়ন্ত সেনগুপ্ত বা ইকো-ট্যুরিজম পার্ক দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিডকো-কর্তা দেবাশিস সেন এই ছাতার আবডাল নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। জয়ন্তবাবুর কথায়, ‘‘বাগানে সিআইএসএফ নিরাপত্তার দিকটুকুই দেখে। যুগলদের আচরণের মাপকাঠি বিচার করেন না।’’ দেবাশিসবাবু বলছেন, ‘‘যুগলদের হয়রানি এড়াতে মহিলা পুলিশেরা থাকেন। তবে ঝোপঝাড় বাড়লে কেটে দিই। চোখের আড়ালে অপরাধও তো হতে পারে।’’
লালবাজার বলছে, কার কী মতলব বলা কঠিন। লেকে যুগলদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ছবি তোলা নিষেধ। প্রকাশ্য প্রেমের পথ তাই নিষ্কণ্টক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy