Advertisement
E-Paper

অতীতের সরণি বেয়ে রাসমণির স্নানবাড়ির খোঁজ

গঙ্গাস্নানের আকর্ষণে রাসমণির কালীঘাটে প্রায়ই যাতায়াত থাকলেও সেখানে তাঁর কোনও বাড়িঘর ছিল না। ক্লান্ত রানিকে ফিরে আসতে হত জানবাজারে।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৩৯
সাক্ষী: প্রবেশপথের দু’ধারে সেই স্তম্ভ।

সাক্ষী: প্রবেশপথের দু’ধারে সেই স্তম্ভ।

পাল্কি বা ফিটন গাড়িতে চেপে এ পথে তিনি এসেছেন বহু বার। গঙ্গাস্নানের আকর্ষণে রাসমণির কালীঘাটে প্রায়ই যাতায়াত থাকলেও সেখানে তাঁর কোনও বাড়িঘর ছিল না। ক্লান্ত রানিকে ফিরে আসতে হত জানবাজারে। তাই তাঁর জীবদ্দশায় কালীঘাটে তৈরি হয়েছিল একটি ঘাট এবং বাগানবাড়ি|

এ শহর জানে না, কী অবস্থায় আছে সে সব। তাই কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্যশালী বাড়ির তালিকায় আতিপাতি করে খুঁজলেও মেলে না হরিশ চ্যাটার্জির ৩০এ, ৩০বি বা ৭১ নম্বরের অস্তিত্ব। কী আছে এই ঠিকানাগুলোয়?

রানি রাসমণিকে নিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করেছেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শিশুতোষ সামন্ত। তাঁর লেখা ‘রানি রাসমণির অন্তহীন জীবনবৃত্তে’-র দ্বিতীয় খণ্ডে লেখক লিখেছেন, রাসমণির উত্তরাধিকারী গৌতম চৌধুরীর থেকে তিনি জানতে পারেন, বাবু রাজচন্দ্র দাসের জীবদ্দশায় ৩০এ এবং ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানায় একটি বাগানবাড়ি রানি কেনেন। ওই বাড়িতেই ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ঠিক আগের দিন সেখানে বসেই দক্ষিণেশ্বর দেবোত্তর সম্পত্তির দলিলে সই করেছিলেন তিনি।

যদি রাজচন্দ্রের জীবদ্দশায় তা তৈরি হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই ১৮৩৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে। কিন্তু লেখকেরই গবেষণায় উঠে এসেছে অন্য তথ্য। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর দশ দিনের মাথায় ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় প্রকাশিত সংবাদে তাঁর তৈরি যে ঘাট এবং গঙ্গাযাত্রী ঘরের নাম রয়েছে তাতে কালীঘাটের কোনও উল্লেখ মেলে না। লেখকের ঘুরে দেখা তথ্যে ধরা পড়ে, ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি দাগে আদিগঙ্গা তীরবর্তী জরাজীর্ণ রাসমণি ঘাট। কিন্তু রানির শেষ প্রহরের সাক্ষী সেই বাড়িটির কোনও সন্ধান মেলেনি।

বাড়ির সামনের অংশের অবস্থা এমনই জরাজীর্ণ।

টালিনালার ধার ধরে হাঁটলে আরও একটি জনশ্রুতি শোনা যায়। ৭১ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট ঠিকানাতেই ছিল রাসমণির স্নানবাড়ি। কারও কাছে এটি স্কুলবাড়ি নামেও পরিচিত। যুক্তি হল, ১৯৪২ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত একটি স্কুল চলত এখানে। সেই বাড়ি আজও আছে। তবে ভগ্নপ্রায় চেহারায়। ৩৬ ঘর ভাড়াটের ভারে ন্যুব্জ, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে তৈরি এই বাড়ি।

ঢোকার মুখে টানা সরু বারান্দা পেরিয়ে সদর মহল। অন্দর মহলে ঢোকার মূল সদরের দু’টি মোটা থাম আজও টিকে আছে। সেই দু’টির সংযোগচিহ্ন হিসেবে রয়ে গিয়েছে লোহার রড। কোনও কালে সেখানে আলো জ্বলত। বছর চল্লিশ আগেও থাম দু’টির উপরে মঙ্গলঘট ছিল। এখনও রাস্তা থেকে প্রায় আড়াই-তিন ফুট উঁচুতে ভিত। ভিতের অংশ ফাঁপা এবং অর্ধচন্দ্রাকারে খোলা| ফলে ভিতের নীচে বাতাস খেলত। এ জন্যই এত বছরেও নোনা ধরেনি। এমনই মত বাড়ির নব্বই বছরের বাসিন্দা, চক্রবর্তী পরিবারের মেয়ে বীথিকা চক্রবর্তীর। তিনি জানান, নব্বই বছর আগে তাঁর বাবা রাসমণির পরিবারের থেকে ভাড়া নেন ছাদের দু’টি ঘর।

সে সময়ে তাঁরা শুনেছিলেন, এ বাড়িই রাসমণির স্নানবাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাড়ির হাতবদল হয়ে যার দুর্গা কুটী নামে এক ব্যক্তির কাছে। এখন তাঁরা ৪৫ টাকা ভাড়ার রসিদ পান শ্রীশ্রী শারদীয়া দুর্গা মাতা ঠাকুরাণী এস্টেট থেকে। ১৯৬৩ সালের দুর্যোগের রাতে এ বাড়ির চৌহদ্দির দোতলা ঘেঁষের বাড়িটি পুরো ভেঙে পড়ে, বলছিলেন আর এক বাসিন্দা তারা বেরা। সেই ঘটনায় তাঁর শাশুড়ি, দেওর-সহ চার জন মারা যান। এখনও রয়েছে তার ভিত। বাবার থেকে শোনা বীথিকাদেবীর স্মৃতিচারণে, ওই বাড়ির একতলায় ছিল ঘোড়ার আস্তাবল আর দোতলায় থাকত সহিস। বাড়ির বাসিন্দাদের ভরসা ছিল দু’টি গঙ্গাজলের কল। একতলা বাড়ির টানা বারান্দা স্পষ্ট দেখা যেত। এখন সেই বারান্দা অদৃশ্য। কারণ যে যাঁর মতো কাঠামো গড়ে সিঁড়িও ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ছাদের ঘরগুলো অবশ্য প্রথম থেকে ছিল না। তা-ও পেরিয়েছে শতবর্ষ। লোহার কড়িবরগা আর জানলার চেহারায় সে সব মালুম হয়।

সরু ইটের থাম, কাঠের কড়িবরগা, চুন-সুরকির মিশেল আর জানলার উপরে খিলানের নকশা বুঝিয়ে দেয় প্রাচীনত্ব। পঁচাত্তর বছর বয়সির স্মৃতিচারণে উঠে আসছিল এ বাড়ির পুরনো চেহারা। “প্রায় ৫০-৬০ মিটার দূরের গঙ্গার জোয়ার দেখতাম ছাদ থেকে। পঞ্চাশ বছর আগেও আদিগঙ্গা দিয়ে ইট, বালি, সুরকি, টালি বোঝাই বড় নৌকা আর স্টিমার যেত। এ বাড়ি আর আদিগঙ্গার মাঝে থাকত এ সবেরই গোলা|”

বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা বাড়িটিতে ইতিমধ্যেই আনাগোনা করছে প্রোমোটারের দল। এত ভাড়াটের বায়নাক্কার জোরেই শুধু টিকে জীর্ণ ঐতিহ্য। যে কোনও দিন বেজে উঠবে সেই মৃত্যুঘণ্টাও।

—নিজস্ব চিত্র।

kalighat house Rani Rashmoni
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy