ভবানীপুর থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ভরসন্ধ্যায় বাড়ির ভিতরেই খুন হয়েছিলেন এক গুজরাতি দম্পতি, অশোক শাহ ও তাঁর স্ত্রী রশ্মিকা শাহ। নৃশংস সেই ঘটনার পরের দিন অকুস্থলে গিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার তৎকালীন নগরপালকে পাশে দাঁড় করিয়ে তিনি দাবি করেছিলেন, খুনের কিনারার ৯৯ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে সেই ঘটনায় পাঁচ জন গ্রেফতার হয়। যদিও সেই খুনের ঘটনার প্রায় তিন বছর পরেও মূল অভিযুক্তকে ধরতে পারেনি পুলিশ।
আবার, বড়তলা থানার কাছেই একটি বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। দিনেদুপুরে একাকী বৃদ্ধার বাড়িতে ঢুকে ছুরি দেখিয়ে নগদ টাকা ও গয়না হাতিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে তিন মাস কেটে গিয়েছে। এখনও ধরা পড়েনি কেউ।
শুধু এই দু’টি ঘটনা নয়, গত কয়েক বছরে কলকাতা শহরে অপরাধের এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যেগুলির কিনারা হয়নি। কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে মূল অপরাধীকেই এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। কোনও ঘটনায় আবার মূল অপরাধী চিহ্নিত হলেও তার নাগাল পাননি তদন্তকারীরা। ভবানীপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে ধরতে না পারার সাফাই দিতে গিয়ে লালবাজারের তদন্তকারীরা একাধিক বার যে যুক্তি দিয়েছেন, তা হল, ওই লোকটি মোবাইল ফোন বা আধুনিক প্রযুক্তির এমন কোনও যন্ত্র ব্যবহার করে না, যা দিয়ে তার হদিস পাওয়া সম্ভব। সে সম্ভবত ভিড়ে এমন ভাবে মিশে আছে যে, তাকে কোনও ভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। শুধু এই ঘটনা নয়, আরও অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই কিনারা না হওয়ার অন্যমত কারণ হিসাবে পুলিশের ব্যাখ্যা, অপরাধী বা অভিযুক্ত ফোন ব্যবহার করছে না।
অর্থাৎ, সোজা কথায়, অপরাধী যদি বুদ্ধিমান হয় এবং অপরাধ-বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হয়, তা হলেই বিপাকে পড়ে যাচ্ছে পুলিশ। প্রযুক্তি-নির্ভরতার চেনা পথে কিনারা হলে ভাল। নইলে সূত্র হাতড়ে হাতড়েই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তার মানে কি যে প্রযুক্তি পুলিশকে ঘটনার কিনারা করার ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য করে, সেই প্রযুক্তির উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতাই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে পুলিশের যোগ্যতা নিয়ে? লালবাজারের কর্তারা যদিও তা মানতে চাননি। এক কর্তার কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতেই সোর্সের পাশাপাশি তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তি-নির্ভর না হলে তদন্তে সফল হওয়া খুব কঠিন। তবে, প্রযুক্তির পাশাপাশি সোর্সদেরও কাজে লাগানো হয়।’’
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলকাতা পুলিশের এলাকা বেড়েছে। বছরখানেক আগে ভাঙড় এলাকাও কলকাতা পুলিশের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এলাকা অনেকটা বেড়ে গেলেও সেই অনুপাতে কর্মী নিয়োগ না হওয়ায় কলকাতা পুলিশ বাহিনীর সমস্যা বেড়েছে। কয়েক হাজার কর্মীর ঘাটতি নিয়েই চলছে বাহিনী। এই কর্মী সঙ্কট প্রভাব ফেলেছে তদন্তের কাজেও। কলকাতা পুলিশ এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দশটি ডিভিশন রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে র্যাফ, স্পেশাল অ্যাকশন ফোর্স, কমান্ডো ফোর্স, কমব্যাট ফোর্স। মেয়েদের সুরক্ষায় ২০১৮ সালে তৈরি হয় ‘উইনার্স’ বাহিনী। তার পরেও অবশ্য আর জি করে ঘটে গিয়েছে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা।
এক সময়ে দক্ষতার নিরিখে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হত কলকাতা পুলিশের। দ্রুত তদন্ত শেষ করাই হোক বা ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ লাগিয়ে অপরাধীকে গ্রেফতারি— সবেতেই নামডাক ছিল বাহিনীর। পুলিশের সেই ‘স্বর্ণ-যুগে’ অপরাধীদের ধরতে ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ই ছিল গোয়েন্দাদের বড় ভরসা। পানশালার কোনও কর্মীই হোন বা জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামি অথবা পাড়ার চায়ের দোকানদার— পুলিশের সোর্সরা ছিলেন সর্বত্র। খবর পাওয়ার জন্য পুলিশের তরফেও নানা ভাবে সাহায্য করা হত সোর্সদের। গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকেরা অনেক সময় গাঁটের কড়ি খরচ করেও সোর্সদের আগলে রাখতেন।
কিন্তু এখন? পুলিশি তদন্তে প্রযুক্তির ভূমিকা বেড়ে যাওয়ায় সোর্সদের গুরুত্ব যে কমেছে, তা স্বীকার করছেন তদন্তকারীরাও। লালবাজারের তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, এখন রাস্তার ক্যামেরা থেকে শুরু করে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থান, টাওয়ার ডাম্পিংয়ের মতো একাধিক উন্নত প্রযুক্তি এসে গিয়েছে তদন্তে ব্যবহার্য হিসাবে। তাই সাদামাটা অপরাধীর নাগাল পাওয়া এখন আগের তুলনায় অনেকটাই সহজ। ফলে সোর্স-নির্ভরতা কমেছে। কিন্তু অপরাধী একটু চতুর হলেই মুশকিলে পড়ছে পুলিশ।
কলকাতার নগরপাল মনোজ বর্মা যদিও বললেন, ‘‘মোবাইল বা প্রযুক্তির সাহায্যেই শুধু তদন্ত হয়, এটা ঠিক নয়। নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি মেনে তদন্ত এগোয়। প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত চলছে।’’ প্রাক্তন পুলিশকর্তা পল্লবকান্তি ঘোষ যদিও প্রযুক্তি-নির্ভরতাকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী বলেই মনে করছেন। তাঁর মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে অপরাধের কিনারার সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরনও এখন বদলে গিয়েছে। আগে এলাকা-ভিত্তিক গতানুগতিক অপরাধ বেশি দেখা গেলেও এখন তার ধরন বদলে গিয়েছে। এক জায়গার অপরাধী অন্য কোথায় গিয়ে অপরাধ করে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র সোর্স নেটওয়ার্ক দিয়ে তদন্তকারীদের পক্ষে এই ধরনের অপরাধের কিনারা করা মুশকিল।’’ তবে, অতিরিক্ত প্রযুক্তি-নির্ভরতা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাংশের কর্মদক্ষতায় কিছুটা হলেও গা-ছাড়া মনোভাব যে এনে দিয়েছে, তা মেনে নিচ্ছেন তিনি। (চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)