সাবধান: বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে ভরসা মুখোশ। ধর্মতলায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সপ্তাহখানেক আগে দিল্লি যাচ্ছিলেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণের আগে জানলা দিয়ে বাইরে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, গ্যাস চেম্বারে ঢুকছেন। বুধবার সকালে কলকাতায় একটি বণিকসভার অনুষ্ঠানে সে
কথাই জানাচ্ছিলেন কল্যাণবাবু। ঘটনাচক্রে, তার আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলে বায়ুদূষণের হিসেবে ‘গ্যাস চেম্বার’ দিল্লিকে টেক্কা দিয়েছিল তাঁর নিজের শহর!
কলকাতার মার্কিন দূতাবাসের হিসেবে, মঙ্গলবার বিকেল তিনটের সময়ে কলকাতার বায়ুদূষণের সূচক ছিল ২৮৩। সোমবার তা ছিল ২৫১। বুধবার দুপুরের পরে রোদ ওঠায় কিছুটা দূষণমুক্তি ঘটে শহরের। এ দিন বিকেল তিনটেয় দূষণ-সূচক নেমে আসে ১৭৮-এ। পরিবেশকর্মীদের প্রশ্ন, দিল্লি নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে অনেকেরই। কিন্তু তিলোত্তমা কলকাতাকে দূষণের গ্রাস থেকে বাঁচতে রাজ্যের পর্ষদ কী করছে? এ ক্ষেত্রে পরিবেশ দফতরের কর্তাদের বাঁধা উত্তর, জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-র সঙ্গে মিশে উপায় বার করার চেষ্টা চলছে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অবশ্য মার্কিন দূতাবাসের পরিমাপকে আমল দিতে নারাজ। পর্ষদের কর্তাদের যুক্তি, পার্ক স্ট্রিটে দূতাবাস চত্বরে যে ভাবে যন্ত্র বসানো হয়েছে, তা যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি। এ দিন দূতাবাস সূত্রে বলা হয়েছে, শহরের একটি জায়গাতেই তাঁরা অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) মাত্রা পরিমাপ করে। তা গোটা শহরের ছবি বোঝায় না। ফলে তাদের পরিমাপের সঙ্গে পর্ষদের পরিমাপ আলাদা হতে পারে। তাই মার্কিন পরিবেশ রক্ষা সংস্থা (ইপিএ) এই সব মানগুলিকে গাণিতিক পদ্ধতিতে সূচকে পরিণত করে। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে এই সূচক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশবিদেরা।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতার পরিমণ্ডলও গ্যাস চেম্বারের থেকে ভাল কিছু নয়। বিশেষত, শীতের এই সময়টায় আকাশ মেঘে ঢাকা দেখলেই সাবধান! কারণ, মাথার ঠিক উপরে কুয়াশার আস্তরণ হিসেবে যা বিছিয়ে রয়েছে তাতে রয়েছে হাজারো বিষ। কী নেই তাতে! গাড়ির ধোঁয়া থেকে বেরোনো কার্বন কণা, বেঞ্জিন যৌগ, সিসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্মাণকাজের জন্য বাতাসে মিশে থাকা বালি, ইট, পাথর, অ্যাসবেস্টসের গুঁড়ো। এগুলি (কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, বেঞ্জিন যৌগ, সিসা) ফুসফুসে বা শ্বাসনালীর কোষে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এদের কারও কারও বিষক্রিয়ায় ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে বলে জানাচ্ছেন শারীরবিজ্ঞানীরা। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দূষণের সূচক ১০০-র উপরে থাকলেই তাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর সেই মাত্রা যদি ২০০ ছাড়ায়, তা হলে সেই অবস্থা ‘ভীষণ অস্বাস্থ্যকর’। যদিও এ দেশে সূচক ২০০-র নীচে থাকলে তাকে ধরা হয় ‘অস্বাস্থ্যকর নয়’।
আবহবিদেরা বলছেন, কলকাতার এই ‘গ্যাস চেম্বার’ হয়ে ওঠার পিছনে দায়ী জোড়া ঘূর্ণাবর্ত। তার প্রভাবেই জলীয় বাষ্প ঢুকেছে পরিমণ্ডলে এবং সেই জোলো হাওয়া বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে ঘনীভূত হয়ে মেঘ-কুয়াশা তৈরি করেছে। বাতাসে ভেসে থাকা দূষিত কণাগুলিকে তা জমাট বাঁধিয়েছে। বেলা গড়ালেও সেই চাদর সরেনি। দিল্লিতেও পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে এ দিন একই পরিস্থিতি হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল তিনটেয় দিল্লিতে বায়ুদূষণের সূচক ছিল ২২৭। বুধবার পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে সেই মাত্রা ওই একই সময়ে বেড়ে হয়েছে ৪১৮। যা মানুষের শরীরের পক্ষে মারাত্মক।
পরিবেশবিদ এবং জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, কলকাতা শহরে ১৫ বছরের পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ি, ডিজেল-চালিত বাস, ট্যাক্সি, পুরসভার জঞ্জালবাহী ট্রাক, পুলিশের পুরনো ভ্যান দূষিত ধোঁয়া ছড়ায়। তার উপরে সম্প্রতি মেট্রো এবং অন্য নির্মাণকাজের ধুলো তো আছেই। সব মিলিয়ে বাতাস এমনিতেই বিষাক্ত। তার উপরে বছরের এই সময়টায় আবহাওয়া থাকে খুবই অস্থির। বঙ্গোপসাগর উপকূলে ঘন ঘন তৈরি হয় ঘূর্ণাবর্ত। উত্তর ভারত পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে। শীতকালে বাতাস এমনিই ভারী থাকে। তার উপরে জলীয় বাষ্প ঢুকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে।
আবহাওয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণ
নেই মানুষের। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, পরিবেশ দফতর কি দূষণে
রাশ টানবে?
প্রশ্ন রয়েছে। সদুত্তর নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy