ভোট আসে, ভোট যায়। কুমোরটুলির উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি দেয় সব দলই। কিন্তু উন্নয়ন সেই তিমিরেই!
উন্নয়নে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল বাম আমলেই। ঠিক হয়েছিল, প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক মানের স্টুডিও গড়ে তোলা হবে কুমোরটুলিতে। যার জন্য শিল্পীদের অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রে সরানোর কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ জমি-জটে আটকে যায় কুমোরটুলিকে ‘মডেল’ পাড়া হিসেবে গড়ে তোলার এই প্রকল্প। নিমাই পাল, মিন্টু পাল, বাবু পাল কিংবা রঞ্জিত পাল শিল্পীদের সকলের মুখে একই কথা, “সরকার পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছিলাম। সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। কেউ কথা রাখেননি।”
পাঁচ বছর আগে পুর-বোর্ডে ক্ষমতায় আসার পরে এ পাড়ায় পা রেখে খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাম আমলের অসমাপ্ত কাজ শেষ করবেন তাঁরা। প্রকল্পের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। ফের দোরগোড়ায় আর এক পুরভোট। কুমোরটুলি কিন্তু আছে কুমোরটুলিতেই। “ভেবেছিলাম, নতুন সরকার শিল্পীদের স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হবে। কিন্তু এই সরকার মৃৎশিল্পীদের মৃত শিল্পী হিসেবে দেখছে,” আক্ষেপ শিল্পী বাবু পালের।
২০০৬ সালে সাংসদ হওয়ার পরে সিপিএমের সুধাংশু শীল কুমোরটুলির উন্নয়নে এগিয়ে আসেন। কেএমডিএ-র তরফে সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, এ, বি, সি এবং ডি চারটি ব্লকে ভাগ করে কুমোরটুলি সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। সেই মতো সি ব্লকের ১০০ শিল্পীকে ২০১০ সালে অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রে সরানো হয়। শিল্পীদের বলা হয়েছিল, দেড় বছরের মধ্যেই অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে কুমোরটুলি পাড়ায় ফিরিয়ে আনা হবে তাঁদের। কিন্তু এখনও গোলাবাড়ির অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রেই রয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
শিল্পী নিমাই পাল, রমেশ পাল, প্রশান্ত পাল, কমল পালদের ক্ষোভ, ‘‘আশ্বাস দিয়ে কুমোরটুলি থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসা হল। কিন্তু মডেল পাড়া না হওয়ায় পুনর্বাসন কেন্দ্রেই বাস করতে হচ্ছে আমাদের।’’ তাঁদের কথায়, ‘‘প্রতিমার অর্ডার দিতে সাধারণ মানুষ কুমোরটুলিতেই আসেন। পুনর্বাসন কেন্দ্র কেউ চেনেন না। ফলে আর্থিক ভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’’
বাম আমলের প্রস্তাবিত প্রকল্প থমকে গেল কেন? কেএমডিএ-র অবসারপ্রাপ্ত আধিকারিক অনুপ ঘোষ বলেন, ‘‘কুমোরটুলির অধিকাংশ এলাকাই ঠিকাজমির আওতাভুক্ত । ওই জমি ভূমি সংস্কার দফতর কেএমডিএ-কে হস্তান্তর করেনি।’’ ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তাঁর কথায়, ‘‘জমি হস্তান্তরে ঠিকাপ্রজা, ঠিকামালিক ও ভাড়াটেরা রাজি ছিলেন না।’’ প্রাক্তন বাম সাংসদ সুধাংশু শীলের কথায়, ‘‘প্রস্তাবিত প্রকল্প আন্তর্জাতিক মানের। সমস্ত শিল্পীকে কুমোরটুলিতে রেখেই উন্নয়নের পরিকল্পনা ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হল না।’’ স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা পাল্টা বলেন, ‘‘কুমোরটুলির যাবতীয় সর্বনাশ বাম আমলে হয়েছে। পুনর্বাসনের নামে ওঁরা রাজনীতি করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে শিল্পীদের একজোট হতে হবে। পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আছে।’’
অন্য দিকে, স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর মিতালি সাহার বক্তব্য, ‘‘কুমোরটুলির উন্নয়নে শিল্পীরা কখনওই প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসেননি। আগামী দিনে এলে প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে দলের তরফে সার্বিক ভাবে আলোচনা করব।’’ এ বিষয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
শিল্পীদের অভিযোগ, ক্ষমতায় আসার পরে জমি-জটের সমাধানে উদ্যোগী হয়নি নতুন সরকার। আরও অভিযোগ, সরকার পরিবর্তনের পরে শিল্পীদের নিয়ে আর একটি সমান্তরাল শাখা সংগঠন তৈরি হয়। নামকরণ করা হয় কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্প ও সাজশিল্প সমিতি। নয়া সমিতির সম্পাদক অপূর্ব পালের কথায়, “এখানকার বেশির ভাগ শিল্পী উন্নয়নের বিপক্ষে। এখানকার ঠিকাপ্রজারা মডেল পাড়া নির্মাণের বিরুদ্ধে।” মৃৎশিল্পীদের নিয়ে পুরনো সংগঠন কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক রঞ্জিত পাল যদিও বলেন, “কুমোরটুলির সমস্ত শিল্পীই চান, উন্নয়ন হোক। আসলে উন্নয়নে বাধা দিতে তৃণমূল প্রভাবিত প্রগতিশীল সমিতির প্রতিনিধিরা উন্নয়নবিমুখ কথা বলে চলেছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy