Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘হেরিটেজ বিদ্রোহ’ পুরসভার অন্দরেই

নিত্য নতুন হেরিটেজ-বৃত্তে এত মাত্রা যোগ হচ্ছে যে, সেখানে এই কাজ করতে গেলে সংরক্ষণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং হাতেকলমে সংরক্ষণের কাজের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু পুরসভার যে ২০ জন তালিকাভুক্ত ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই সেই যোগ্যতা নেই বলে দাবি অপর পক্ষের।

জীর্ণ: সংস্কারের অভাবে বেহাল দশায় শহরের এমনই অনেক বাড়ি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

জীর্ণ: সংস্কারের অভাবে বেহাল দশায় শহরের এমনই অনেক বাড়ি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৩
Share: Save:

শহরের হেরিটেজের সংরক্ষণ হবে কী ভাবে! কারণ, কলকাতা পুরসভার নথিভুক্ত হেরিটেজ স্থপতিদের অধিকাংশেরই সেই যোগ্যতা নেই। বাইরের কারও অভিযোগ নয়! গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া ‘বিশ্ব হেরিটেজ সপ্তাহে’র শুরুতেই এমন ‘হেরিটেজ-বিদ্রোহ’ শোনা গিয়েছে খোদ পুরসভার অন্দরে।

পুরসভার ‘এমপ্যানেল্‌ড কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’দের একাংশের দাবি, পুরসভা দায়িত্ব নিয়ে হেরিটেজ সংরক্ষণের জন্য যাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছে, তাঁদের সিংহভাগেরই সে সংক্রান্ত যোগ্যতা নেই। ফলে হেরিটেজ সংরক্ষণের কাজের মান তথৈবচ! যদিও পুর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নিয়ম অনুসারেই হেরিটেজ স্থপতিদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। তা নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে চিঠি দেওয়া যেতে পারে।

হেরিটেজ স্থপতিরা বলছেন, হেরিটেজ সংরক্ষণ আদতে বিশেষজ্ঞদের কাজ। আগে শুধু আর্কিটেক্টের ডিগ্রি থাকলেই এ কাজ করা যেত। কারণ, এ দেশে হেরিটেজ সংরক্ষণের ধারণা খুব পুরনো নয়। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরে হেরিটেজ-ভ্রমণ, হেরিটেজ জ়োন-সহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ফলে নিত্য নতুন হেরিটেজ-বৃত্তে এত মাত্রা যোগ হচ্ছে যে, সেখানে এই কাজ করতে গেলে সংরক্ষণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং হাতেকলমে সংরক্ষণের কাজের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু পুরসভার যে ২০ জন তালিকাভুক্ত ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই সেই যোগ্যতা নেই বলে দাবি অপর পক্ষের।

রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা পুরসভার তালিকাভুক্ত ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘আর্কিটেকচারে স্নাতক হলেই সংরক্ষণের কাজ করা যায় না। কারণ, এটি একটি স্পেশালাইজ়ড কাজ। সংরক্ষণের বিষয়ে স্নাতকোত্তর হওয়া খুবই প্রয়োজন।’’ আর এক ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ নীলিনা দেব লাল বলেন, ‘‘শুধুমাত্র আর্কিটেকচার পড়েই যদি সংরক্ষণের কাজ করা যেত, তা হলে সংরক্ষণ নিয়ে আলাদা করে পড়াশোনার প্রয়োজনই তো হত না।’’ নীলিনার আরও দাবি, অনেক সরকারি দফতরেরই হেরিটেজ সংরক্ষণ নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। অথচ হেরিটেজ ভবন রং করা থেকে সংস্কার— সব কাজ করে থাকে সেই সংশ্লিষ্ট দফতরই।

পুরসভার নথিভুক্ত আর এক সংরক্ষণবিদ জানান, অনেক সময়েই এমন হয়, এক জন খুব ভাল কাজ করছেন। অথচ তাঁর প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কারণ, তিনি সংরক্ষণে স্নাতকোত্তরের বিষয়টি পড়ে এসেছেন। ওই সংরক্ষণবিদের কথায়, ‘‘আগে থেকে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সেই যোগ্যতা না থাকলেও তাঁরা এতটাই ভাল কাজ করেন বা এতটাই অভিজ্ঞ, তাঁদের নথিভুক্ত করা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বাকিরা তা নন।’’ তার ফলেই হেরিটেজ সংস্কারের কাজ অনেক জায়গায় ঠিকমতো হচ্ছে না বলে দাবি করছেন তাঁরা।

এই বিতর্কের সমাধানে পার্থরঞ্জনবাবুদের পরামর্শ, পুরসভার তালিকাভুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন সরংক্ষণবিদদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হোক যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন যে, তালিকাভুক্ত ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ হিসাবে কারা নির্বাচিত হবেন। সে ক্ষেত্রে যাঁরা ভাল কাজ করছেন বা প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে, তাঁদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ওই তালিকায়।

পুরসভার অবশ্য পাল্টা যুক্তি, সংরক্ষণের কাজ করতে আর্কিটেকচারে স্নাতক হওয়াই যথেষ্ট। তা ছাড়া পুরসভার হেরিটেজ কমিটি অনুমোদন করার পরেই কারও নাম ‘কনজারভেশন আর্কিটেক্ট’ হিসেবে নথিভুক্ত করে পুরসভা। এক পদস্থ কর্তার বক্তব্য, ‘‘স্নাতক হল সাধারণ যোগ্যতা মান। আইএএস হতে গেলেও স্নাতক হওয়াই যথেষ্ট।’’ যার প্রতিক্রিয়ায় পার্থরঞ্জনবাবু বলছেন, ‘‘আইএএস হওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু সার্জন হতে গেলে সার্জারি নিয়ে পড়তে হয়। কারণ তার জন্য বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন। আসলে হেরিটেজ নিয়ে পুরসভার ধারণা তো এটাই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এ শহরে হেরিটেজের অবস্থা ঠিক কোথায়!’’

রাজ্য হেরিটেজ কমিশন অবশ্য এই বিতর্কের মধ্যে ঢুকতে নারাজ। কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘এ অভিযোগটা শুনিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE