প্রতীকী ছবি।
দেশের বাইরে চাকরি করতে এসে প্রথমেই শুনেছিলাম, আমরা চাকরি করি পরিবারের জন্য। তাই পরিবারের সুবিধা-অসুবিধাটাই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায় এখানে। একে অপরের মতামতকে সম্মান দিই। তাই ভোট, ভোটের জন্য রাস্তায় প্রচার— কোনও কিছুই দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক চলার ছন্দকে ব্যাহত করে না। দুঃখের কথা, আমার নিজের দেশে সেটা হয় না। সেখানে নিজের মতামতটা অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়াটাই মুখ্য। তাই এত গন্ডগোল, তাই এত মারামারি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। কখনও দিল্লি, কখনও মালয়েশিয়া-কানাডা-বম্বে-সিঙ্গাপুর হয়ে অবশেষে ২০০৪ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে ব্রিটেনে থিতু হয়েছি। যাদবপুরে বাড়ি আমার। দু’বার (’৮৯ এবং ’৯১ সাল) সেখান থেকেই ভোট দিয়েছি। রিডিং-এ স্ত্রী আর যমজ ছেলেদের নিয়ে থাকি। লন্ডনে অফিস। এখনও বছরে দু’বার বাড়ি ফেরা চাই-ই চাই, মা-কে দেখতে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এক কথায় বলতে পারি, ওখানে ভোট দেওয়াটাকে মিস করি। ভোটের সময়টাকে নয়।
ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার সুবাদে এত বছরে বেশ কয়েক বার এখানে ভোট দিয়েছি। ভোটের সময়টাকেও দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, এ ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে কতটা তফাত! এখানে ভোট দেওয়ার সময় থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। অর্থাৎ, আপনি অফিস থেকে ফিরে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ধীরেসুস্থে ভোট দিতে যেতে পারেন। আই-কার্ড দেখানোর বালাই নেই। রাস্তার নাম আর বাড়ির নম্বর বলে দিলেই হল! ভোটের নামে রাস্তা আটকে প্রচারের ব্যাপারই নেই। কারণ, এখানে যদি কেউ তাঁকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানাতে গিয়ে রাস্তা আটকে জনজীবন ব্যাহত করেন, তা হলে তখনই নিশ্চিত যে, তিনি ভোটে হারছেন। ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে অবশ্য এখানে নোংরামি কিছু কম হয়নি, কিন্তু তা সাধারণ জনজীবনকে কোনও ভাবেই বিঘ্নিত করেনি।
ভারতের অবস্থা ঠিক এর উল্টো। ভোটের নামে রাস্তা জুড়ে মিছিল আর তার পরে কলেজে ঢুকে তাণ্ডব— এখানে কিন্তু ভাবাই যায় না! গত মঙ্গলবার বিদ্যাসাগর কলেজে তাণ্ডবের ঘটনার পরে এখন একে অপরকে দোষ দেওয়ার পালা চলছে। ভোটের আগে হিংসা, মারামারি, গোলাগুলি, মৃত্যু লেগেই রয়েছে। কিন্তু কেন হয় এ সব? দেশের সেবা করতে ক্ষমতায় আসতে চায়, শুধু সেই জন্য? একটা কারণ তো দুর্নীতি করার লাইসেন্স। আর একটা কারণ, পুলিশের নিরপেক্ষতার অভাব। দেশে ক্ষমতাসীন দলের এক জন সাংসদ শত অন্যায় করেও পার পেয়ে যান সহজে। কারণ তিনি জানেন, যা-ই করুন না কেন, পুলিশ পিছনে আছে। আজ যদি সাধারণ মানুষ স্থির করে, যে বিজেপি-তৃণমূল মারামারির কারণে বিদ্যাসাগরের মূর্তির এই অবস্থা, তাদের কাউকেই ভোট দেব না, তা হলেই ভবিষ্যতে কেউ এমন করার সাহস দেখাবে না!
ব্রিটেনে কিন্তু ভোটের আগে এমন সব ঘটনা ভাবাই যায় না। খেয়াল করে দেখবেন, এখানে মীমাংসা না হওয়া বহু পুরনো শিশু নির্যাতনের মামলাগুলি খুঁড়ে বার করে দোষীকে শাস্তি দেয় এরা। তাই অপরাধ করে কেউই যে পার পাবেন না, তা সকলেই বিলক্ষণ জানেন। এখানে দেশের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। দেশ নিয়ে গর্ববোধও অনেক বেশি। আর আমার অভাগা দেশে? আত্মসম্মানও নেই, দেশের প্রতি ভালবাসাও নেই। দেশের সম্পত্তি নষ্ট করব না, সেই ভাবনাটাই কারও মাথায় আসে না। আরে দেশে তো কেউ নিজের প্রাণের মায়াই করেন না! অন্যের কথা কী ভাববেন। না হলে বারবার দুর্ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও দিনের পর দিন লোকে হেলমেট ছাড়াই বেপরোয়া ভাবে বাইক চালায়?
তবে এর জন্য কি আমরা সকলেই দায়ী নই? ভারতে উচ্চশিক্ষিতেরা রাজনীতিতে আসেন না। রাজনীতির কাদা ঘেঁটে পরিষ্কার করতে কেউই আগ্রহী নই। তবে আশা করি, যে দিন রাজনীতিকেরা রাজনীতিকে নিছক পেশা বলে ভাববেন না, সেই দিন হয়তো এই অবস্থার উন্নতি হবে।
(লেখক একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy