Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

আড্ডায় একটাই কথা, মিলবে কি বুথ ফেরত সমীক্ষা

চর্চা: বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে চায়ের দোকানে আলোচনা। সোমবার, ধর্মতলায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

চর্চা: বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে চায়ের দোকানে আলোচনা। সোমবার, ধর্মতলায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ০২:৪২
Share: Save:

তা হলে মোদীই জিতে গেলেন? উত্তর কলকাতার রাজবল্লভপাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে প্রশ্নটা তুলেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের বাসিন্দা, প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী স্নেহময় গঙ্গোপাধ্যায়। ভোরবেলার চায়ের আড্ডা আরও কয়েক মিনিট আগে থেকেই সরগরম বুথ ফেরত সমীক্ষার আলোচনায়। প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে দফায় দফায় নস্যি টানা অভ্যাস স্নেহময়বাবুর। আর এক টিপ নস্যি নিয়ে নিশ্চিন্তে বললেন, ‘‘শেষ মুহূর্তে ঠিক জায়গাতেই তা হলে ভোটটা দিয়েছি!’’

স্নেহময়বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই খবরের কাগজ নিয়ে চায়ের আড্ডায় হাজির দেবকল্যাণ হাজরা নামে আর এক বৃদ্ধ। শ্লেষের হাসি হেসে ঝাপসা চশমার কাচ মুছে সত্তরোর্ধ্ব বললেন, ‘‘যেমন নাটুকে প্রধানমন্ত্রী, তেমন নাটুকে তোমাদের সমীক্ষা। কাগজ দেখে মনে হচ্ছে, স্কুলমাস্টারের মতো রাত জেগে খাতা দেখে নির্বাচন কমিশন রাতারাতি ফল প্রকাশ করে দিয়েছে! আরে বাবা, ভোটারের মন বোঝা এত সহজ কাজ নয়।’’ চারটে চায়ের জায়গায় পাঁচটা দিতে বলে জনা পাঁচ বৃদ্ধের ভোটের ফলের বিশ্লেষণ চলল আরও ঘণ্টাখানেক। রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তাপ বাড়াল সেই ফলাফল-চর্চা!

রবিবারই শেষ হয়েছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন। আগামী বৃহস্পতিবার ফল ঘোষণা। তার আগে রবিবার রাত থেকেই জোর আলোচনা শুরু হয়েছে বুথ ফেরত সমীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে। প্রায় সব সমীক্ষাই বলছে, কেন্দ্রে সরকার গড়ছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে কেউই ২৫০ আসনের কম দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির ভোট এবং আসন, দুই-ই বাড়ছে বলে দেখিয়েছে সমীক্ষার ফল। এই প্রেক্ষিতে শহর কলকাতার চা-চর্চার বিষয়ও বদলে গিয়েছে রাতারাতি। আইপিএল, ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ভোটের হিংসা, দলবাজি, মারামারি ছেড়ে সবাই এখন ব্যস্ত ফলাফল কী হবে, সেই আলোচনায়। উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতার প্রায় প্রতি চায়ের ঠেকের আড্ডার কেন্দ্রে— ভোটের ফলের সঙ্গে সমীক্ষার ফল মিলবে কি না, সেই কথা!

নিমতলা শ্মশান লাগোয়া একটি চায়ের দোকানে এক হিন্দিভাষী শোনাচ্ছিলেন তাঁদের উত্তরপ্রদেশের ‘সুদিনের’ গল্প। তাঁকে পাল্টা দিতে শোভাবাজার মোড়ের বাসিন্দা সোমনাথ হালদার বললেন, ‘‘এ বার তোমার রাজ্যেই বিজেপি আগের বারের ফল ধরে রাখতে পারবে না ভাই। তুমি ছেড়ে দাও।’’ ওই দোকানেই চা খেতে দাঁড়ানো সুশান্ত কর্মকার নামে এক জন বললেন, ‘‘সমীক্ষা তো বলছে উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি ভাল করবে। সেখানে যদি আসন কম পড়ে, বাংলা এবং ওড়িশা ভরিয়ে দেবে।’’ গঙ্গার পাড়ে হেঁটে ক্লান্ত আর এক মাঝবয়সি চায়ের দোকানের টেবিলে বসে বললেন, “তা দেবে মনে হয়।”

বিকেলের দিকে মানিকতলার বাগমারি পার্কের আড্ডার চর্চা আবার পৌঁছল ২০০৪ সালে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের এক কর্মী বলছিলেন, ‘‘সে বার তো অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার গড়ছেনই বলে সব সমীক্ষায় দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ফল হল উল্টো। বাজপেয়ীর ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ কিন্তু সে বার ভোট পায়নি।’’ কল্যাণবাবুর কথায় প্রবল উত্তেজিত সুষমা জা‌না নামে প্রাথমিক স্কুলের এক কর্মী বলেন, ‘‘কাল বরাহনগরের বুথে আমার ডিউটি পড়েছিল। আগের বিধানসভা ভোটেও কাজ করতে গিয়ে তৃণমূলের নেতাদের বাইক নিয়ে ঘুরে যেতে দেখেছি। তাঁদের সে কী দাপট! এ বার তো শুনলাম, তাঁরাই নাকি চুপচাপ বিজেপিতে ভোট দিয়ে গিয়েছেন।’’ সব্যসাচী সরকার নামে আর এক জনের টিপ্পনী, “একা তৃণমূল কেন, সিপিএমও তো নাকি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবে ঠিক করেছে। সেই কাঁটা উল্টে না তাদের গায়েই ফোটে!”

মধ্য কলকাতার সূর্য সেন স্ট্রিটের ফেভারিট কেবি‌নে গোটা দশেক পুরনো বই এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে পৌঁছে দিয়ে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার পরিতোষ ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘বুঝলেন না, এ সব হচ্ছে শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা রাখার কায়দা। সব চক্রান্ত। মিথ্যার মাথাকে কেউ নেতা হিসেবে বেছে নিতে পারে না। সমীক্ষাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে।’’ কয়েকটা টেবিল দূরেই চায়ের কাপ হাতে তি‌ন যুবক-যুবতীর আলোচনা চলছিল তাঁদের অফিসের পরিস্থিতি নিয়ে। কয়েক মিনিট পরেই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘তোরা তো মমতা-মোদীর মতো করছিস। তোদের কাছে সবই চক্রান্ত। দেখ না, এই বুথ ফেরত সমীক্ষাও নাকি চক্রান্ত।’’

টা‌নটান ফলাফল-চর্চার মধ্যেই মজার কথা শোনালেন নেতাজিনগরের বাসিন্দা বিজয় সেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ওই ছাত্র খেলার মাঠে মোবাইল খুলে দেখালেন ফেসবুকে জনৈকের পোস্ট। তাতে লেখা, ‘ভাগ্যিস মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের এগজ়িট পোল হয় না। তা হলে রেজাল্ট বেরোনোর দু’দিন আগে থেকেই বাবা-মায়েরা যে কী করতেন!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE