Advertisement
E-Paper

‘দম দাও’ আজও বেঁচে দমকল ডাকেই

মোড়ের মাথায় তখন স্থানীয় মানুষের ভিড়। তাঁরা তখন লম্বা লোহার আলমারি সদৃশ একটি যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে। ওই আলমারির সামনের কাচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে এক জন টেলিফোনের হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে যাচ্ছেন। আর পাশের মানুষেরা উত্তেজিত হয়ে বলছেন, ‘দম দাও আরও জোরে দম দাও। আগুন যে ক্রমেই বাড়ছে!’

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯ ০২:২৬
স্মৃতি: দম দেওয়া সেই টেলিফোন (১) হেদুয়ার সামনে (২) বিধানসভা ভবনে (সংগৃহীত)। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

স্মৃতি: দম দেওয়া সেই টেলিফোন (১) হেদুয়ার সামনে (২) বিধানসভা ভবনে (সংগৃহীত)। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

দম দাও। আরও জোরে দম দাও। আগুন যে দাউ দাউ করে জ্বলছে।

মোড়ের মাথায় তখন স্থানীয় মানুষের ভিড়। তাঁরা তখন লম্বা লোহার আলমারি সদৃশ একটি যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে। ওই আলমারির সামনের কাচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে এক জন টেলিফোনের হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে যাচ্ছেন। আর পাশের মানুষেরা উত্তেজিত হয়ে বলছেন, ‘দম দাও আরও জোরে দম দাও। আগুন যে ক্রমেই বাড়ছে!’

এটা ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের শুরুর দিক। সে সময়ে কলকাতা শহরের হাতে গোনা বাড়িতে টেলিফোন ছিল। দমকল ডাকতে এলাকার মোড়ের মাথায় রাখা থাকত লোহার বাক্সের ভিতরে টেলিফোন। সেই টেলিফোনের হাতলে দম দিয়েই দমকল ডাকতেন মানুষ। হাতল ঘুরিয়ে দম দিতেই ঘণ্টা বাজত সোজা দমকলের ডিভিশনাল অফিসে। কোন এলাকা থেকে এই ঘণ্টা বাজছে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা বুঝে যেতেন ডিভিশনাল অফিসের কর্মীরা। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দমকল পাঠাতেন। দম দিয়ে দমকল ডাকা হত বলেই ফায়ার ব্রিগেডের নাম বাংলায় হয়ে গেল দমকল। মাটির নীচে কেব্‌ল লাইনের মাধ্যমে ওই টেলিফোনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত ডিভিশনাল অফিসের টেলিফোনের।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দমকলের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, ওই ফায়ার অ্যালার্ম তৈরি করিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বার্নার্ড অ্যান্সন ওয়েস্টব্রুক। তখন সাধারণ বাড়িতে ফোন ছিল না। তাহলে কোথাও আগুন লাগলে দমকল জানবে কী ভাবে? কারণ, লোকমুখে দফতরে যখন খবর যাবে, তত ক্ষণে সব ভস্মীভূত হয়ে যাবে। সমস্যার সমাধান করলেন ওয়েস্টব্রুক। তিনিই শহরে ফায়ার অ্যালার্ম বসান। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে প্রায় ১৫০টির মতো এমন দম দেওয়া টেলিফোন ছিল। দমকলের প্রবীণ অফিসারেরা জানাচ্ছেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ধীরে ধীরে বাড়ি, অফিস, দোকানে টেলিফোন চলে এলে বন্ধ হয়ে যায় দম দেওয়া টেলিফোন।

কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডের ডিভিশনাল অফিসার পৈরাগ মল্লিক আটের দশকে দমকল বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘যখন শহরে দমকলের ডিভিশনাল অফিসার ছিলাম তখন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিকাণ্ডে এই পদ্ধতিতেই দমকলকে খবর দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যিস ওই দম দেওয়া টেলিফোন যন্ত্র ছিল! না হলে খবর পেতাম কী ভাবে?’’ ষাটের দশকের প্রথম দিক। হাতিবাগান বাজারে বড় আগুন লাগল। স্থানীয়েরা সেই খবর দিয়েছিলেন টেলিফোনের হাতলে দম দিয়েই।—জানালেন পৈরাগবাবু।

প্রবীণ অফিসারেরা জানাচ্ছেন, যে এলাকায় আগুন লাগত, সেখানকার মানুষ কাচ ভেঙে হাতল ঘুরিয়ে দম দিতে শুরু করতেন। সেই ঘণ্টা শুনে ফায়ার স্টেশন থেকে দমকলের গাড়ি চলে যেত ঘটনাস্থলে। কিন্তু গাড়ি তো জানে না কোথায় আগুন লেগেছে। তাই যে দম দেওয়া টেলিফোন থেকে খবর পৌঁছত সেখানেই পৌঁছে যেত গাড়ি। এর পরে স্থানীয় বাসিন্দারাই দমকলের গাড়িকে নিয়ে যেতেন ঘটনাস্থলে। দমকলের আরেক প্রবীণ অফিসার বিভাস গুহ বলেন, ‘‘মনে হতে পারে হয়তো পুরো প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে অনেক সময় লাগত। তা কিন্তু লাগত না। দ্রুত দমকলের গাড়ি চলে যেত ঘটনাস্থলে। তখন তো শহরে এত গাড়ি আর যানজট ছিল না। তাই ডাক পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দমকলের গাড়ি চলে যেত। সেখান থেকে ঘটনাস্থলে যেতে সময় লাগত খুব বেশি পাঁচ থেকে দশ মিনিট।’’

শহরে টেলিফোন বহুল প্রচলিত হওয়ার পরে দম দেওয়ার মাধ্যমে ডাকার ওই পদ্ধতিও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে আজও কয়েকটি মোড়ে যন্ত্রগুলি অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ভাঙাচোরা অবস্থায় সেগুলি। শুধু খাঁচাটুকু পড়ে রয়েছে কোথাও। তারই একটি রয়েছে হেদুয়ার কাছে বেথুন কলেজের বিপরীতে। কাচ ভাঙা, ভিতরের যন্ত্র উধাও। আরও একটি রয়েছে বিধানসভা ভবনের ভিতরে। সেটি অবশ্য সাজানো রয়েছে।

সেটুকুতেই টিকে আছে এ শহরে ফায়ার ব্রিগেডের ‘দমকল’ হয়ে ওঠার কাহিনি।

Kolkata Fire Brigade
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy