ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
মাথার উপরে খোলা আকাশ, ঝিলের উপর দিয়ে ভেসে আসা ঝিরঝিরে হাওয়া, অনেকখানি সবুজ আর পাখির কলকাকলি। যেন স্বপ্ননীড়।
আমার পাড়া সেনহাটির নামকরণ হয়েছিল পূর্ববঙ্গের খুলনা জেলায় ফেলে আসা এক গ্রামের নামে। প্রবীণদের মুখে শুনেছি, দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বুকে চেপে ভিটেমাটি হারা কিছু মানুষ এ শহরে এসে ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেছিলেন। তাঁরাই ধীরে ধীরে জমি কিনে চলে এলেন বেহালায়। গড়ে তুললেন সেনহাটির এই পাড়া। গড়ে উঠল বাড়ি-ঘর, স্কুল, ডাকঘর, বাজার এমনকী কমিউনিটি সেন্টারও।
আজকের সেনহাটিকে দেখে অবশ্য সেই সাবেক চেহারাটার হদিস করা মুশকিল। অসংখ্য বাড়ি, বহুতলে ছেয়ে থাকা পাড়ায় তখন বেশির ভাগই চাষের জমি। বিয়ে হয়ে ইস্তক, সেই ১৯৬৮ থেকে এখানে রয়েছি। শুরুর সেই দিনগুলোয় মাত্র ২৫-৩০টি পরিবারের বসবাস ছিল এখানে। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে জনসংখ্যা। অতীতে মূলত ছিল মধ্যবিত্তের বাস। এখন পাশাপাশি রয়েছেন উচ্চমধ্যবিত্তরাও। কিছু কিছু পরিবারে সদস্যসংখ্যা বাড়ায় স্থানাভাবে বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাট। কিছু বহুতলে নতুন মুখেরা এলেও পুরনোরা তাঁদের আপন করে নিয়েছেন।
আমাদের বাড়ির কাছের পুকুরটার নাম মালির পুকুর। কাছেই বামাচরণ রায় রোড, চণ্ডীতলা ব্রাঞ্চ রোড। ও দিকে সত্যেন রায় রোড এবং রায় বাহাদূর রোড গিয়ে মিশেছে জেমস লং সরণিতে। আগের চেয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে ঠিকই, চালু হয়েছে অটো রুট। তবে জেমস লং সরণি কিংবা নিউ আলিপুর পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যান চলাচল বাড়ালে এলাকার মানুষের যাতায়াতে সুবিধা হয়।
এখনকার সেনহাটি পরিচ্ছন্ন, ঝাঁ-চকচকে। নতুন পুরনো অসংখ্য বাড়ি-বহুতল, পুকুর-ঝিল আর শান্তিপূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশের পাড়াটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এলাকার মানুষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তবে মালির পুকুরে মাঝেমধ্যে জঞ্জাল ভাসতে দেখি। কারা যেন এসে পুকুরপাড়ে আবর্জনা ফেলে যান। খারাপ লাগে খুব। জানি না কবে বন্ধ হবে! তেমনই ঝিলের চারপাশ লোহার গ্রিলে ঘেরা থাকলেও ভিতরে পাড়ের কাছে বেশ কিছু জায়গায় আগাছা জন্মেছে। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ হলে পাড়ার সৌন্দর্য আরও বাড়বে।
এ পাড়া এখনও সুন্দর তার আন্তরিকতায়। সকলেই যেন কত আপন। সকলেই সকলকে চেনেন। আজও একডাকে পাশে পাওয়া যায় প্রতিবেশীদের। তাঁরা আত্মীয়সম। মনে পড়ছে, এ পাড়ারই এক প্রবীণ দীর্ঘ পাঁচ বছর কোমায় থাকাকালীন পাড়ার ছেলেরাই পালা করে হাসপাতালে থাকত। এমন অন্য পাড়ায় হয় কি না জানা নেই।
আড্ডাটাই মানুষে-মানুষে যোগাযোগটা ধরে রেখেছে। সকালে ঝিলের ধারে আর সন্ধ্যায় মাঠে বয়স্কদের আড্ডা বসে, আশপাশের ক্লাবে সদস্যদের আসর জমে রাতের দিকটায়। ছুটির দিনে পরিচিতরা কারও বাড়িতে জুটে গল্পগুজবে
মাতেন। আধুনিক হাজারো বিনোদনের মাঝেও আড্ডার মাদকতা এখানে আজও অক্ষুণ্ণ।
তবে খেলাধুলোর ছবিটা বদলেছে। ছুটির দিনে চিলড্রেন্স পার্কে পাড়ার ছোটদের দেখা মিললেও মাঠে এখন বেপাড়ার ছেলেদেরই ভিড়। পাড়ার ক্রিকেট কিংবা ফুটবল টুর্নামেন্ট টিকে আছে। শীতের সন্ধ্যায় আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্যারম খেলার ছবিটাও পাল্টায়নি তেমন।
পুজোপার্বণের টানে আজও ঘরে ফেরেন প্রবাসীরা। আগে পুজো হতো সেনহাটি শিক্ষা নিকেতন স্কুলে। পরে পুজোটি স্থানান্তরিত হয় চিলড্রেন্স পার্কে। সময়ের সঙ্গে জাঁকজমক বাড়লেও সাবেক রীতিনীতি ও নিষ্ঠা আজও অটুট। এখনও পাড়ার মহিলারা শুদ্ধাচারে নাড়ু তৈরি থেকে পুজোর জোগাড়ে সামিল হন। ব্যস্ততা সামলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, পুজোর দিনগুলোয় একত্রে খাওয়াদাওয়ায় মাতে গোটা পাড়া। আশপাশের কিছু ক্লাবের উদ্যোগে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করা হয়।
বর্তমানের মাঝেই উঁকি দেয় এ পাড়ার অতীত। মনে পড়ে পাড়ার মন্মথ গুপ্ত, হিমাংশু সেনের কথা। বিপদে আপদে পাড়া-পড়শির পাশে দাঁড়াতেন। কাছেই থাকতেন নাট্যকার দীপেন সেনগুপ্ত এবং চিকিৎসক অশোক দাশগুপ্ত। রাতবিরেতে যে কোনও সময়ে প্রয়োজনে রোগীর বাড়ি যেতেন তিনি। আমার ছেলেই তো এক বার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমাদের গৃহচিকিৎসক শহরে নেই। নিরুপায় হয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়ে সমস্যার কথা জানাতেই ছুটে এসেছিলেন। আমার ছেলেকে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনিই।
এমন একটা পাড়া ছেড়ে যেতে কি কারও মন চায় কখনও?
লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy