Advertisement
E-Paper

গ্রামে প্রস্তুত কনে, শহরে ধ্বংসস্তূপের তলায় প্রণব

মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ মাঝেরহাট সেতুর একাংশ ভেঙে পড়ে। মৃত্যু হয় এক যুবকের। আহতের সংখ্যা কুড়িরও বেশি।ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকেই গৌতমবাবু ও প্রণববাবুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

নীলোৎপল বিশ্বাস ও ফিরোজ ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:০২
হাহাকার: মাঝেরহাট সেতুর ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রণব দে-র দেহ। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তাঁর আত্মীয়-পরিজন। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

হাহাকার: মাঝেরহাট সেতুর ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রণব দে-র দেহ। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তাঁর আত্মীয়-পরিজন। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

কয়েক মাস বাদেই বিয়ে। মেয়ে দেখে রেখেছেন বাড়ির লোকজন। কথা ছিল, ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে তিনি আর শহরে ফিরবেন না। বিয়ে করে থাকবেন গ্রামের বাড়িতেই। নিজেদের জমিজমায় চাষ-আবাদ করেই দিন গুজরান করবেন।

সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। সেই পরিকল্পনা থেকে গেল পরিকল্পনাতেই। তা সাকার হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে মাঝেরহাটের ভেঙে পড়া সেতু। বুধবার সন্ধ্যায় সেই সেতুর ধ্বংসস্তূপে পাওয়া গিয়েছে প্রণব দে (২৪)-র দেহ। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের গ্রামে। এই নিয়ে বুধবার রাত পর্যন্ত মাঝেরহাট সেতু ভাঙার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল দুই। এখনও নিখোঁজ মাঝেরহাট সেতু সংলগ্ন মেট্রো রেল সাইটে নিযুক্ত ঠিকা কর্মী গৌতম মণ্ডল। তাঁরও বাড়ি মুর্শিদাবাদে। ভাঙা সেতুর সামনে অন্তহীন অপেক্ষায় তাঁর পরিবার।

মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ মাঝেরহাট সেতুর একাংশ ভেঙে পড়ে। মৃত্যু হয় এক যুবকের। আহতের সংখ্যা কুড়িরও বেশি।ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকেই গৌতমবাবু ও প্রণববাবুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। খবর পেয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে ছুটে আসেন তাঁদের বাড়ির লোকজন। কেউ বুধবার ভোর ৪টে থেকে, কেউ বা মঙ্গলবার রাত থেকেই তাঁদের অপেক্ষায় বসে আছেন অকুস্থলে। প্রণববাবুর খোঁজে এ দিন এসেছেন তাঁর আত্মীয় পার্থ দে এবং পরিমল দে। পার্থবাবু জানান, প্রণববাবুর বাবা প্রহ্লাদ দে ছ’বছর আগে পথ-দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। প্রণববাবুর গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন তাঁর মা ময়নাদেবী এবং ছোট ভাই উৎপল। প্রধানত প্রণববাবুর উপার্জনেই চলত সংসার। ছোট ভাই উৎপল বহরমপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাঁর পড়ার খরচও জোগাতেন প্রণববাবু।

পার্থবাবু বলেন, ‘‘মেয়ে দেখা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন পরেই ছাদনাতলায় বসার কথা ছিল প্রণবের। বাড়ির সকলেই ওকে বলেছিল, যথেষ্ট হয়েছে। আর শহরে ফিরতে হবে না। গ্রামেই জমিজমা রয়েছে, চাষ-আবাদ করুক। কিন্তু শুনল না। সব শেষ হয়ে গেল।’’ পরিমলবাবু জানান, প্রণববাবুর মা ময়নাদেবীকে এখনও ছেলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। তিনি টিভি দেখে সমানে প্রশ্ন করে চলেছেন, ‘‘বাবু (প্রণব) ঠিক আছে তো?’’ আর প্রণববাবুর ভাই উৎপল কান্নায় ভেঙে পড়া গলায় আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘‘দাদা বেঁচে আছে কি না, জানতে শহরে যেতে চাইছিলাম। মা কিছুতেই ছাড়ল না।’’ এ দিন সন্ধ্যায় প্রণববাবুর দেহ উদ্ধারের পরে ঘটনাস্থলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর পরিবারের এক জন।

আরও পড়ুন: ‘বিকট শব্দ, বাবা চাপা পড়ে গেল’

একই অবস্থা মুর্শিদাবাদের তেঁতুলিয়ায় গৌতমবাবুর বাড়িতে। বছর আটচল্লিশের গৌতমবাবু ছেলে তোতনকে নিয়ে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে সম্প্রতি কলকাতায় আসেন। সেতু ভেঙে পড়ার পর থেকে বাবা যে নিখোঁজ, সেই খবর মা অনীতাদেবীকে এখনও জানাতে পারেননি তোতন। তাঁর কথায়, ‘‘মাকে কিছু বলাই যাবে না। শুধু বলেছি, বাবা আশেপাশেই রয়েছে। ভাল আছে।’’ সময় যত গড়াচ্ছে, বাবাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তোতনের।

তোতন জানান, তাঁর বাবা গৌতমবাবু ঠিকা কর্মীদের জন্য রান্নার কাজ করেন। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার বিকেলে মাঝেরহাট সেতুর শিবিরে রান্নার তোড়জোড় করছিলেন তিনি। তোতন ঘুমিয়ে ছিলেন সেতুর উল্টো দিকের একটি শিবিরে। হঠাৎ জোর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। তার পর থেকে গৌতমবাবুকে আর দেখা যায়নি। গৌতমবাবুর খোঁজে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন অরুণ মণ্ডল। প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে অরুণবাবু বলেন, ‘‘গৌতমের স্ত্রী বাড়িতে একা। ছেলেটা বাবার জন্য এখানে পড়ে রয়েছে। সরকারের কেউ এখনও এসে কথা বলল না! কোনও রকম সাহায্য পাব কি না জানি না। গৌতমের দেহটা অন্তত দিয়ে দিক। গ্রামে ফিরে যাই।’’ তাঁদের আশঙ্কা, গৌতমও আর নেই।

আরও পড়ুন: রেলকে খোঁচা মমতার, পাল্টা যুক্তি রেলেরও

ভেঙে পড়া সেতুতে উদ্ধারকাজে পুলিশ-প্রশাসনের শশব্যস্ত তৎপরতা এই দুই পরিবারের উৎকণ্ঠা প্রশমিত করতে পারছে না। আশা দেওয়া তো দূরের কথা। দু’টি পরিবারের লোকজন শুধু বলছেন, ‘‘এখন এ শহর ছাড়তে পারলে হয়!’’

Death Majerhat মাঝেরহাট Majerhat Bridge
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy