পঞ্চাশ মিনিটের রাস্তা পার হতে সময় লাগল পাক্কা তিন ঘণ্টা। বাসে চুপ করে বসে থাকতে হল দীর্ঘক্ষণ। বেহালা যে আদৌ কলকাতার অংশ, সেটা আর মনে হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার অফিসে যাওয়ার সময়ে মনে হচ্ছিল, অন্য কোনও জেলা থেকে কলকাতায় ঢুকছি বুঝি। কারণ, যে পথে অফিসে গেলাম, সেই পথে শেষ কবে গিয়েছি মনে নেই। তার উপরে দোসর যানজট। বেহালার ম্যান্টন থেকে চাঁদনি চকে পৌঁছতে আগে যেখানে ৫০ মিনিট লাগত, এ দিন সেটাই লেগে গেল তিন ঘণ্টা! হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম, মাঝেরহাট সেতুর গুরুত্ব কতটা।
গত মঙ্গলবার ওই সেতু ভেঙে পড়ার পর থেকেই আশঙ্কাটা হচ্ছিল। কী ভাবে অফিসে যাতায়াত করব? এ দিন যে চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হলাম, তার পর থেকে এখন একটাই চিন্তা। কত দিন এ ভাবে চালাতে পারব? সেতু ভেঙে পড়ায় কলকাতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে গোটা বেহালা। গত কয়েক বছর ধরে ২২২ রুটের বাসে করে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে মাঝেরহাট সেতু পেরিয়ে অফিসে এসেছি। না হলে বাড়ি থেকে হাঁটাপথে ডায়মন্ড হারবার রোডে পৌঁছে অটোয় উঠে কালীঘাটে নেমেছি। তার পরে মেট্রো করে চাঁদনি চকের অফিসে।
কিন্তু এ দিন বাড়ি থেকে বেরোনোর পরে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও ফাঁকা অটো পাইনি। ঠাকুরপুকুর থেকে আসা সমস্ত অটোতেই যাত্রী ভর্তি ছিল। ম্যান্টন থেকে অবশেষে সাড়ে ন’টা নাগাদ ২২২ রুটের একটি বাস পেলাম। ভাবলাম, যাক কিছু তো একটা পাওয়া গেল। তখনও ভাবতে পারিনি, আমাকে কতটা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে।
আরও পড়ুন: রেলিং থেকে পথ, জরাজীর্ণ সবই
বাসটি তারাতলা থেকে বাঁ দিক ঘুরে সেই যে দাঁড়িয়ে পড়ল, ব্যস! চাকা আর নড়ে না। কোনও ভাবে বাস গড়িয়ে হাইড রোডে ওঠার পরেও ফের একই অবস্থা। অনেকের মুখে শুনেছিলাম, যানজটে মানসিক চাপ বাড়ে। আজ সেটা বুঝলাম নিজেকে দিয়ে। কারণ, বেলা ১১টার মধ্যে অফিসে ঢোকার কথা থাকলেও পৌনে ১১টায় আমি খিদিরপুরেই পৌঁছতে পারিনি। ফলে বাড়তে থাকে মানসিক চাপ। আরও দুশ্চিন্তায় ছিলাম কারণ, এই শহরের রাস্তাঘাট আমি তেমন একটা চিনি না। প্রায়ই রাস্তা গুলিয়ে ফেলি। যদি চালক হঠাৎ জানিয়ে দেন যে, বাস আর যাবে না, তখন আমি কী করব? তখন বাইরে প্রবল বৃষ্টি। আর ঝড় বইছে আমার মনে। কোনও ভাবে খিদিরপুরের কাছে পৌঁছলাম। ফের যানজট। আরও বেশি ভাবাচ্ছিল, কত দিন এ ভাবে যাতায়াত করতে হবে? তার পরে বিভিন্ন রাস্তায় মণ্ডপ তৈরি হলে তো ভোগান্তিও বাড়বে।
বেহালার বাসিন্দাদের কপাল এতটাই পোড়া যে, মেট্রোর কাজ হওয়ার কারণে রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। শুকনো হলে ধুলোর সমস্যা। বৃষ্টি হলে জল-কাদা। আগে তবু যানবাহন সময় মতো পাওয়া যেত! এটুকুই মনকে সান্ত্বনা দিতাম। কিন্তু এ বার তো ত্রিফলায় বিদ্ধ হলাম। মেরামতি হয়তো হবে, কোনও এক দিন সেতুতে আবার গাড়িও চলবে বলে আশা রাখি। সেতু ভাঙার দায় কার, তা নিয়ে ঠেলাঠেলি না করে সরকারের এখন দ্রুত বিকল্প উপায় বার করা উচিত। কিন্তু তত দিন ভোগান্তি ও মানসিক চাপ থেকে কী ভাবে মুক্ত থাকব, সেটা ভেবেই কূল পাচ্ছি না। মাঝেরহাট সেতুর বিপর্যয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গোটা ছকই বদলে দিল। বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরোনো ও দেরিতে ফেরাকেই অভ্যেস করে নিতে হবে। এবং অধিকাংশ সময়ই কাটাতে হবে রাস্তার যানজটে। এটাই আপাতত কঠিন ও নিষ্ঠুর বাস্তব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy