টোপটা ছিল মোক্ষম। ‘মামা-কে সরিয়ে দিতে পারলে তুমিই হবে দাদা।’ ইট-বালি-সিমেন্ট জোগানের ব্যবসায় একচেটিয়া প্রভাব কায়েম হবে এলাকায়।
নুর মহম্মদের ব্যবসার পনেরো বছরের অংশীদার শামিম আখতার ওরফে কেলো এই টোপটাই গিলে ফেলল। আর রাত ১টার পর বাড়ি থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের নাম করে ডেকে এনে নুরকে কার্যত ঠেলে দিল বন্দুকধারী আততায়ীদের মুখে। না হলে কেলো ব্যবসার বড় অংশীদার নুরকে (যাকে সে মামা বলে ডাকত) শিক্ষা দিতে চেয়েছিল ঠিকই, তবে খুন পর্যন্ত ভাবেনি। ভাবতে পারল তখনই, যখন নুরের পুরনো শত্রু, এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের লক্ষ্যে থাকা মহম্মদ সালাউদ্দিন তাকে টোপ দিল।
শুক্রবার রাতে মল্লিকবাজারের ব্যবসায়ী নুর মহম্মদকে খুনের ঘটনার মূল চক্রী হিসেবে সেই সালাউদ্দিনকে রবিবার রাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ওই দিন দুপুর থেকেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছিল। এলাকায় সালাউদ্দিন সুদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। শামিম ওরফে কেলোকে গ্রেফতার করা হয়েছিল শনিবার রাতে। সালাউদ্দিনের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে খিদিরপুর তল্লাটের দুই যুবককে। তাদের নাম: খুরশিদ আলম ওরফে চিন্টু এবং শেখ মইনউদ্দিন ওরফে রাজ। এদের মধ্যে রাজই নুরকে গুলি করেছিল বলে পুলিশের একাংশের দাবি।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের খবর, নুর মহম্মদকে খুন করতে খিদিরপুরের ওই দু’জনকে লাখ খানেক টাকার সুপারি দিয়েছিল সালাউদ্দিন। খুনের অস্ত্রও সে-ই সরবরাহ করেছিল। তার বাড়ি থেকে একটি ছ’ঘরার রিভলভার, বুলেট, ছুরি, দু’টি চপার ও ফ্ল্যাশ হাইডার নামে একটি সরঞ্জাম মিলেছে। পুলিশ জেনেছে, রিভলভার বা পিস্তলের মুখে ওই ফ্ল্যাশ হাইডার লাগায় দুষ্কৃতীরা, যাতে গুলি করার সময়ে আগুনের ঝলকানি না হয়। তবে শুক্রবার তা ব্যবহৃত হয়েছিল কি না, পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
সোমবার ডিসি (ইএসডি) দেবস্মিতা দাস বলেন, ‘‘নুর মহম্মদের খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিবার রাতে সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে জেরা করে ওয়াটগঞ্জ থানা এলাকার কবিতীর্থ সরণি থেকে আরও দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়।’’ ডিসি জানান, সালাউদ্দিনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে একটি কালো ব্যাগ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি মিলেছে।
এ দিন তিন ধৃতকে শিয়ালদহ আদালতে হাজির করানো হয়। তাদের ২৪ জুন পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোটরবাইকে করে চার দুষ্কৃতী এসে নুরের উপর হামলা চালিয়েছে। গুলি ছুড়েছিল দু’জন। তবে পুলিশের দাবি, একটি মোটরবাইকে দু’জনই এসেছিল। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে টাকা ধার দিয়ে ফেরত নেওয়ার সময়ে দ্বিগুণ টাকা চাইতে গিয়ে নুরের কাছে কেলো প্রকাশ্যে চড় খায়। ওই ঘটনার পর থেকে ফুঁসছিল কেলো। নুরকে শিক্ষা দিতে সালাউদ্দিনের সঙ্গে গোপনে হাত মেলায় কেলো। কারণ, সে জানত, নুরকে সালাউদ্দিন নিজের প্রধান শত্রু বলে মনে করে। মল্লিকবাজার ও লাগোয়া মহল্লায় সালাউদ্দিন নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, অথচ নুরের সঙ্গে সে এঁটে উঠতে পারছে না।
পুলিশের একটি সূত্রের খবর, নুরকে কেলো কিন্তু প্রথমে খুন করার কথা ভাবেনি। এমনকী, সালাউদ্দিনের মুখে ওই পরিকল্পনার কথা শুনে প্রথমটায় সে ভয় পেয়ে যায়। পরে সালাউদ্দিন তাকে বোঝায়, নুর না থাকলে কেলোই ওই তল্লাটে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের ব্যবসা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বিশেষ করে, পনেরো বছর ধরে কেলো যেখানে নুরের সঙ্গে থেকে ব্যবসার অন্দিসন্ধি অনেকটাই বুঝে নিয়েছে। তার পর কেলো আর নুরকে খুনের জন্য সালাউদ্দিনের ছকে কোনও বাধা দেয়নি। উপরন্তু সে নিজেই বড় ভূমিকা নিয়েছিল নুর মহম্মদ হত্যাকাণ্ডে।
পুলিশের মতে, নুরের বাড়িতে বা বাড়ির কাছে গিয়ে তাঁকে খুন করা মুশকিল ছিল। সে কথা মাথায় রেখেই ছক কষা হয়।
লালবাজার সূত্রে খবর, এলাকায় একটি বহুতল তৈরির জন্য ইট-বালি-সিমেন্ট সরবরাহের ঠিকা নিয়েছিল নুর। সেই জন্য বেশ কিছু দিন ধরে, রাতে মল্লিকবাজার মোড়ের পাশে লরি থেকে সরঞ্জাম ফেলা হচ্ছিল। সেটা সালাউদ্দিনকে জানায় কেলো।
খুনের রাতেও ঘটনাস্থলের পাশে একটি বালির লরি আসে। ঠিক হয়, কেলো ফোন করে ডেকে আনবে নুরকে। কিছুক্ষণ তাঁকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখবে। এর মধ্যে পার্ক সার্কাস থেকে মোটরবাইক চালিয়ে ঘটনাস্থলে আসবে চিন্টু ও রাজ। সেই মতো একটি বাইকেরও ব্যবস্থা করে চিন্টু। পরিকল্পনা মতোই নুরকে ডেকে আনে কেলো। এর পর রাজ গুলি করে নুরকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy