Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বকেয়া করের সুদ ছাড়ে ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে মেয়র পরিষদ

কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদকে হাতিয়ার করে সম্পত্তিকর ছাড়ে ‘বদান্যতা’ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। বিধানসভায় এই নয়া বিধি পাশ হলে (যার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত) কোনও আবেদনকারীর বকেয়া সম্পত্তিকরের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ মেয়র পরিষদ নিজ সিদ্ধান্তে মকুব করতে পারবে। ওয়েভার স্কিমে সুদ মকুবের সংস্থান থাকলেও প্রচলিত পুর-আইনে সুদ মকুবের ক্ষমতা মেয়রের নেই। আছে শুধু জরিমানা মকুবের অধিকার।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদকে হাতিয়ার করে সম্পত্তিকর ছাড়ে ‘বদান্যতা’ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। বিধানসভায় এই নয়া বিধি পাশ হলে (যার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত) কোনও আবেদনকারীর বকেয়া সম্পত্তিকরের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ মেয়র পরিষদ নিজ সিদ্ধান্তে মকুব করতে পারবে। ওয়েভার স্কিমে সুদ মকুবের সংস্থান থাকলেও প্রচলিত পুর-আইনে সুদ মকুবের ক্ষমতা মেয়রের নেই। আছে শুধু জরিমানা মকুবের অধিকার।

পুর-নির্বাচনের মুখে এই সিদ্ধান্তের পিছনে ভোটে জেতার অঙ্ক কাজ করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে, এই ধরনের পদক্ষেপ কার্যত ‘নিজেদের পছন্দের লোক’কে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সহজ পদ্ধতি। পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, এতে গরিব মানুষের সুবিধা হবে। সরকারি সূত্রের খবর, কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদে গৃহীত এই প্রস্তাব রাজ্য মন্ত্রিসভায় পাশ হয়েছে। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “মেয়র পরিষদের প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রিসভায় কী হয়েছে, জানি না।”

মেয়র পরিষদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও কলকাতা পুর-আইনে (১৯৮০) ওই ধরনের ক্ষমতা দেওয়া নেই। তার জন্য আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন। পুর-প্রশাসনের বিশ্বাস, বিধানসভায় তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা পাশ হয়ে যাবে। যা ভোটের আগে শাসকদলের পালে বাড়তি হাওয়া জোগাতে পারে।

পুরসভার কর মূল্যায়ন দফতরের খবর, ২০০১ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিন বার ওয়েভার স্কিম চালু করেছিল পুরসভা। সে ক্ষেত্রে বকেয়া করদাতাদের সকলেই সুদ ও জরিমানায় ছাড় পেয়েছেন। এ বারের প্রস্তাবে বকেয়া সকলের জন্য সুদে ছাড় মিলবে না। মেয়র পরিষদ যাঁদের ছাড় দেওয়ার প্রয়োজন মনে করবে, তাঁরাই ছাড় পাবেন। বকেয়া করদাতা পুরসভায় আবেদন করবেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে কাকে ছাড় দেওয়া হবে, তা ঠিক হবে মেয়র পরিষদের বৈঠকে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রেও ‘আমরা-ওরা’র তত্ত্ব চলে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। যা মূলত পুরভোটের দিকেই নজর রেখে করা হচ্ছে বলে অনুমান বিরোধীদের।

পুরসভা সূত্রের খবর, মাসখানেক আগেই ওই প্রস্তাব মেয়র পরিষদে এবং পুরসভার অধিবেশনে পাশ করানো হয়। পুরসভার এক অফিসার জানান, প্রথম দিকে ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল কাকে ছাড় দেওয়া হবে তা ঠিক করার ক্ষমতা থাকবে মেয়রের উপরে। পরে অবশ্য মেয়রের পরিবর্তে পুরো মেয়র পরিষদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার কথা প্রস্তাবে লেখা হয়েছে।

পুরসভার কর মূল্যায়ন দফতরের এক কর্তা জানান, সম্পত্তিকর সময়ে জমা না পড়লেই সুদ চাপে। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ, কেউ পাঁচ বছর কর বাকি রাখলে তার বকেয়া কর প্রায় দ্বিগুণ হয়। নতুন ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বকেয়া করদাতাকে প্রথমে আবেদন করতে হবে। জানাতে হবে কেন তিনি কর জমা দিতে পারেননি। সেই আবেদন যুক্তিযুক্ত মনে হলে সুদের উপরে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হবে। ওই অফিসার বলেন, ওই নিয়মে বকেয়া করদাতারা সকলেই হয়তো আবেদন করতে পারবেন, তবে সকলেই ওই সুযোগ পাবেন না।

পুরসভার এক মেয়র পারিষদের ব্যাখ্যা, “হাসপাতালে তো অনেক রোগীই যান। সবাই তো ছাড় পান না। যাঁরা গরিব, তাঁদের ছাড় দেওয়া হয়। এখানেও সে রকমই ভাবা হয়েছে।” এটা তো দলের পক্ষে ভোট টানার সহজ পথও হতে পারে? ওই মেয়র পারিষদ বলেন, “প্রতি ক্ষেত্রেই প্রশাসকের হাতে বিশেষ ক্ষমতা থাকে। সেটা কী ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটাই দেখার। মেয়রও তো ক্ষমতা বলে অনেকের বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদন করে দিতে পারেন। কিন্তু তা তো করা হয় না।”

প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “প্রয়োজনের ভিত্তিতে জরিমানা মকুব সব সময়েই করা হত। কিন্তু সুদ কখনওই নয়। এরা সুদ মকুব করার পথে গিয়ে দুর্নীতিতে আইনি মোহর দিতে চাইছে। যাতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শ্রীকান্ত মোহতাদের মতো লোকজন সুযোগ পেতে পারেন।”

পুরসভার কংগ্রেস কাউন্সিলর মালা রায়ের বক্তব্য, “ওয়েভার স্কিম এড়াতে আইন সংশোধনের পথে যাচ্ছে তৃণমূল বোর্ড। ২০১২-এ ওয়েভার স্কিম করতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল পুর-প্রশাসনকে। রাজ্যপাল বারংবার ফিরিয়েছিলেন সেই অনুমোদন। এ বার তাই নতুন চাল।” পুরসভার এক আমলার ব্যাখ্যায়, ওয়েভার ছিল সকলের জন্য। তাতে রাজ্যপালের অনুমোদন জরুরি। এ বার বলা হচ্ছে যাঁরা কর জমা দিতে না পারার পিছনে উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারবেন, তাঁদেরই সুদে ছাড় দেওয়া হবে। অর্থাৎ সকলকে যে ছাড় দেওয়া হবে না, তা বোঝাতে চায় পুর-প্রশাসন। আর সেখানেই অনেকের প্রশ্ন, কে ছাড় পাবে, কে পাবে না, তা নির্ধারণের মাপকাঠি কী? কারণ সবটাই মেয়র পরিষদের ইচ্ছানির্ভর।

কর মূল্যায়ন দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, শেষ বার ২০১২ সালে ওয়েভার স্কিম করে পুরসভা। তার আগে পুরসভার প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ অ্যাসেসির মধ্যে সম্পত্তিকর বকেয়া ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষের। করের পরিমাণ ছিল দু’হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ৩০১ জনের বকেয়া করের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।

এ বার কী তাঁরাও ছাড় পাবেন? এর জবাব দেননি কর দফতরের অফিসারেরা। তাঁদের কথায়, সব কিছুই মেয়র পরিষদের হাতে। তাঁদের নির্দেশ পালন করাই দফতরের কাজ। এখন অপেক্ষা, বিধানসভায় বিল পাশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE