Advertisement
E-Paper

কাজ চলে নাটবল্টু ঝালাই করে

আতঙ্কে চোখমুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল শ্রমিকদের। পোস্তায় বিবেকানন্দ উড়ালপুলে বিমের উপর কংক্রিটের স্ল্যাব তখন ঢালাই করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। হঠাৎই কয়েকটি নাটবল্টু ভেঙে, খুলে বেরিয়ে এল। তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তিকে চেঁচিয়ে ডাকলেন শ্রমিকেরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০২
ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ‘আইভিআরসিএল’-এর ধৃত তিন কর্তা দেবজ্যোতি মজুমদার, প্রদীপকুমার সাহা এবং মল্লিকার্জুন রাও (বাঁ দিক থেকে)। শনিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ‘আইভিআরসিএল’-এর ধৃত তিন কর্তা দেবজ্যোতি মজুমদার, প্রদীপকুমার সাহা এবং মল্লিকার্জুন রাও (বাঁ দিক থেকে)। শনিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

আতঙ্কে চোখমুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল শ্রমিকদের। পোস্তায় বিবেকানন্দ উড়ালপুলে বিমের উপর কংক্রিটের স্ল্যাব তখন ঢালাই করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। হঠাৎই কয়েকটি নাটবল্টু ভেঙে, খুলে বেরিয়ে এল। তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তিকে চেঁচিয়ে ডাকলেন শ্রমিকেরা।

—বাবু দেখুন, কী ভাবে নাটবল্টু খুলে বেরিয়ে আসছে। এখনই কাজ বন্ধ না করলে বড় বিপদ হবে। সব ভেঙে পড়বে।

—দাঁড়াও, কাজ বন্ধ করতে তো আমি বলতে পারি না। জিজ্ঞেস করছি।

এর পর সেই ‘বাবু’ মোবাইলে কাউকে ফোন করে বিষয়টা জানালেন। শ্রমিকদের সামনেই।

—স্যার, নাটবল্টু খুলে বেরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, কংক্রিটের ওজন বিম নিতে পারছে না। লেবাররা বলছে, কাজ বন্ধ করে দিতে হবে।

—(মোবাইলের ও প্রান্তে থাকা ব্যক্তি কিছু বললেন।)

—ওকে স্যার। না, না ঠিক আছে। আমি সেটাই বলছি।

—কাজ বন্ধ করা যাবে না। আমাকে বলা হয়েছে, ‘ক্যারি অন।’ কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নাটবল্টুগুলো ঝালাই করে দিলেই হবে। তোমরা কাজ বন্ধ কোরো না।

নাটবল্টু ভেঙে খুলে বেরিয়ে আসার পরেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বিবেকানন্দ উড়ালপুল।

হাসপাতালে ভর্তি, জখম দুই শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই তথ্য হাতে আসার পরেই উড়ালপুল বিপর্যয়ের ঘটনায় খুনের মামলা রুজু করার সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতা পুলিশ। যদিও ঘটনার অব্যবহিত পরে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর মামলা রুজু করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, ৪০ নম্বর স্তম্ভ বা পিলারের একাংশ আগেই বসে গিয়েছিল আর তার পর বিমের উপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর সময়ে নাটবল্টু ভেঙে, খুলে বেরিয়ে এসেছিল।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের খবর, ‘বাবু’-র মোবাইল ফোনে অন্য প্রান্ত থেকে নির্মাণকাজ ‘ক্যারি অন’-এর নির্দেশ যিনি দিয়েছিলেন, সেই নির্মাণকারী সংস্থা ‘আইভিআরসিএল’-এর সাইট ইঞ্জিনিয়ার তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তন্ময় শীলকে শনিবার বর্ধমান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

লালবাজার সূত্রের খবর, তন্ময়কে শুক্রবারই নির্মাণকারী সংস্থার বাকি দশ কর্তার সঙ্গে লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বাকিরা এলেও তন্ময় আসেননি। গোয়েন্দাপ্রধান দেবাশিস বড়াল জানান, ২০০৯-এর একেবারের গোড়া থেকেই এই উড়ালপুল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তন্ময়। গোয়েন্দাপ্রধানের কথায়, ‘‘উড়ালপুল ভেঙে যাওয়ার এক দিন আগেই ঘটনাস্থলে দেখা গিয়েছে তাঁকে। প্রকল্পের ‘সয়েল টেস্টিং’, ল্যান্ড পাইলিং’-সহ বিভিন্ন পর্যায়ে হাতে-কলমে তদারকির কাজে তন্ময়বাবু সরাসরি যুক্ত ছিলেন।’’ উড়ালপুলের বিভিন্ন অংশ তৈরির জন্য নানা সামগ্রী সরবরাহের বিষয়েও তন্ময়বাবু সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে লালবাজারের কর্তাদের একাংশের দাবি। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, উড়ালপুলের ভেঙে যাওয়া অংশটিতে কাঁচা মাল যিনি সরবরাহ করেন, তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর আত্মীয় সেই রজত বক্সীকে কি তন্ময়ই নিয়োগ করেছিলেন? তদন্তে এ বিষয়টিও দেখা হচ্ছে বলে লালবাজারের দাবি। লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘আইভিআরসিএল নিজেরাই কাঁচা মাল কিনত। সুতরাং রজতবাবু কত দূর দায়ী, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’’ এর থেকে লালবাজার রজতবাবুকে আড়াল করছে কি না, পুলিশের একাংশের মধ্যে সে-প্রশ্নও উঠছে। তবে পুলিশের আর একটি মহলের দাবি, রজতবাবুর খোঁজেও পুলিশি অভিযান ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

তন্ময়বাবুর উপরে কোনও ধরনের চাপ তৈরি হয়েছিল কি না, তা নিয়েও গোয়েন্দামহলে চর্চা হচ্ছে। এমনিতে তন্ময়বাবু ছ’টি উড়ালপুল তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। এর মধ্যে গোয়ায় মাণ্ডবী নদীর উপরে ও জামশেদপুরে সুবর্ণরেখার উপরের সেতুও রয়েছে। সে-ক্ষেত্রে এত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বিবেকানন্দ উড়ালপুলের বিষয়ে তিনি কেন ঝুঁকি নিলেন বা তাঁর বিরুদ্ধে অপেশাদার ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ কেন উঠল, তা গোয়েন্দাদের ধন্দে রেখেছে।

কী ভাবে ধরা পড়লেন তন্ময়বাবু?

বর্ধমান জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার রাতে বর্ধমান-বীরভূমের সীমানায়, মঙ্গলকোটে অজয় নদের কাছে একটি সেতুর মুখে নাকাবন্দি চলার সময়ে একটি গাড়ি আটকায় পুলিশ। গাড়িতে থাকা এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, তাঁর নাম তন্ময় শীল। তিনি কলকাতায় বিবেকানন্দ উড়ালপুলে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁকে আটক করে কলকাতা পুলিশকে খবর দেয় বর্ধমান পুলিশ। শনিবার সকালে কলকাতা পুলিশ বর্ধমান থেকে তন্ময়বাবুকে নিয়ে যায়। তন্ময়ের সঙ্গে তাঁর গাড়ির চালক ফিরোজকেও আটক করা হয়। ফিরোজ উড়ালপুলের নির্মাণকাজে শ্রমিক সরবরাহ করেছিলেন বলে একটি সূত্রে জানতে পারে পুলিশ। পরে অবশ্য ফিরোজকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আইভিআরসিএল সংস্থায় তন্ময়বাবুর ঠিক উপরের ‘বস’-ও এখন পুলিশের নাগালে রয়েছেন। তিনি হলেন, সিনিয়র এজিএম মল্লিকার্জুন রাও। তিনি ছাড়াও, এইচ আর (মানবসম্পদ) বিভাগের অ্যাডমিন দেবজ্যোতি মজুমদার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপকুমার সাহাকে শুক্রবার রাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। এ দিন তাঁদের ব্যাঙ্কশাল কোর্টের অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মধুমিতা বসুর এজলাসে হাজির করানো হয়। সরকারি কৌঁসুলি তমাল মুখোপাধ্যায় ও শুভেন্দু ঘোষ ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজত চাইলেও বিচারক ধৃতদের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এঁদের মধ্যে দেবজ্যোতি মজুমদার অসুস্থ বলে জানিয়ে আদালতে সেই সংক্রান্ত নথি পেশ করেন আইনজীবীরা। বিচারক সে সব দেখে তদন্তকারী অফিসারদের নির্দেশ দেন, পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ে ওই ব্যক্তির চিকিৎসার যাতে ত্রুটি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, সংস্থার আর এক ঊর্ধ্বতন কর্তা রঞ্জিত ভট্টাচার্যকে জেরা করলেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে বলে পুলিশের আশা। তিনি এখন একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া, হায়দরাবাদে গিয়ে আইভিআরসিএল-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরদের ছ’জন সদস্যকেও কলকাতায় আসার জন্য তলব করেছে পুলিশ। এর পাশাপাশি, উড়ালপুলের নকশা প্রস্তুত করেছিল যারা, কলকাতার সেই সংস্থার দুই কর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শনিবার সন্ধ্যায় লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়।

লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তার কথায়, ‘‘ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে জেনেও এত বড় একটা কাজ চালিয়ে যাওয়ার মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যিনি বা যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁরা ভালই জানতেন, উড়ালপুল ভেঙে পড়লে প্রচুর প্রাণহানি হবে। সেই জন্যই আমরা খুনের মামলা রুজু করেছি।’’

ওই কর্তা জানান, ‘ক্যারি অন’ বলার আগে সাইট ইঞ্জিনিয়ার তন্ময়বাবু তাঁর চেয়ে উচ্চপদস্থ, সংস্থার কোনও কর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন কি না, কেনই বা বিপদ ওঁত পেতে আছে জেনেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল, সেটা দেখা হচ্ছে। লালবাজারের এক শীর্ষ অফিসার বলেন, ‘‘কাজ কেন চালিয়ে যেতে বলা হল, সেটা তদন্তের প্রধান বিষয়। কারণ, ওই অবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে কাজ বন্ধ রেখে সতর্কতা নেওয়া হলে এত বড় বিপর্যয় ঘটত না।’’

শ্রমিকেরা বিপদের কথা যাঁকে প্রথম বলেছিলেন, সেই ‘বাবু’টির খোঁজও তদন্তকারীরা করছেন।

পুলিশি তদন্তে বিবেকানন্দ উড়ালপুল নির্মাণে দু’টির ত্রুটির কথা ধরা পড়েছে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, পুজোর আগে বিম তৈরি করে ফেলে রাখা হয়েছিল প্রায় ছ’মাস। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্রুত কংক্রিটের ঢালাই করা স্ল্যাব বিমের উপর ফেলার কথা। এত দিন ফেলে রাখার ফলে বিমে মরচে ধরে আলগা হয়ে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়ার পর লালবাজারের তদন্তকারীরা মনে করছেন, দুর্ঘটনার সেটিও সম্ভাব্য কারণ।

লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিবেকানন্দ উড়ালপুলের একটি বাঁকে ৪০ নম্বর পিলার বা স্তম্ভ ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা আমাদের জানিয়েছেন, ৪০ ও ৪১ নম্বর স্তম্ভের মাঝখানে ৪০-এ নামে একটি পিলার বা স্তম্ভের প্রয়োজন ছিল। তা হলেও বিপর্যয় এড়ানো যেত। কার গাফিলতি বা ত্রুটিতে তা হয়নি, সেটাও দেখা হচ্ছে।’’

গোয়েন্দারা খড়্গপুর আইআইটি ও যাদবপুরের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়ার পাশাপাশি ন্যাশনাল টেস্ট হাউসেরও সহায়তা নেওয়ার কথা ভেবেছেন।

নির্মাণের সময় গাফিলতি কেন নজরে এল না, তা জানতে শনিবার লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছিল কেএমডিএ-র এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার শান্তনু মণ্ডল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারইন্টেডেন্ট শুভঙ্কর ভট্টাচার্যকে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল-এর নেতৃত্বে তদন্তকারীরা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy