Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শীতলা-মনসার সঙ্গে টক্কর দিয়ে শহরে বাড়ছে হনুমান পুজোও

‘‘অনেক বছর বিদেশে কাটিয়ে তখন সবে ফিরেছি আমি। বছর চারেক আগে এক সন্ধ্যায় মোড়ের মুখে হঠাৎ শুনি কিছু লোকের মোবাইলের রিংটোনের মতো ‘হনুমান চালিসা’ পাঠ হচ্ছে। দেখি সেই মনসার চাতালের চিহ্নমাত্র নেই!’’

ক্যানাল সাউথ রোডের হনুমান মন্দির (বাঁ দিকে)। কলেজ স্ট্রিটে বিকোচ্ছে বাংলা অনুবাদে হনুমান চালিসা (ডান দিকে)। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ক্যানাল সাউথ রোডের হনুমান মন্দির (বাঁ দিকে)। কলেজ স্ট্রিটে বিকোচ্ছে বাংলা অনুবাদে হনুমান চালিসা (ডান দিকে)। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০৩:৩৭
Share: Save:

নিজের পাড়ার চেহারাও এ ভাবে পাল্টে যেতে পারে!

বদলের স্মারক, বেলেঘাটা সিআইটি মোড়ের সঙ্কটমোচন মন্দির। গন্ধমাদন কাঁধে দাঁড়িয়ে পবননন্দন হনুমান। কয়েক দশক আগে সেখানে মনসার চাতালে নাটকীয় ভঙ্গিতে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি শোনা যেত আকছার। বাড়ির কাজের দিদির হাত ধরে বসে তখন বেহুলার কষ্টে কেঁদে ভাসাত কোনও মুখচোরা কিশোর। শনিবার পাড়ার পুরনো গল্প শোনাচ্ছিলেন এ তল্লাটের পুরনো বাসিন্দা, কালচারাল স্টাডিজ়ের শিক্ষক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়।

‘‘অনেক বছর বিদেশে কাটিয়ে তখন সবে ফিরেছি আমি। বছর চারেক আগে এক সন্ধ্যায় মোড়ের মুখে হঠাৎ শুনি কিছু লোকের মোবাইলের রিংটোনের মতো ‘হনুমান চালিসা’ পাঠ হচ্ছে। দেখি সেই মনসার চাতালের চিহ্নমাত্র নেই!’’ ‘কালনেমির লঙ্কাভাগে’র মতো মনসার চাতাল ভেঙে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির, একটি জলসত্র ও শিব মন্দির হয়েছে। এলাকার তৃণমূল নেতার সৌজন্যে রাস্তার ডিভাইডারে শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদার কয়েকটি মূর্তি মায় একুশের ভাষা শহিদদের স্মারকও বসেছে। কিন্তু ফি-সন্ধ্যায় ভক্তদের জমায়েতে হনুমানজিরই জয়জয়কার।

কাছেই ক্যানাল সাউথ রোডের হনুমান মন্দিরটিরও ‘স্বাস্থ্য’ ফিরেছে ২০১৪-য় ‘অচ্ছে দিন’-এর হাত ধরেই। মৈথিলী ব্রাহ্মণ পুরোহিত দুর্গেশ্বর ঝা শোনালেন, বাঁশের মাচার মতো খুপরিটা তখনই স্থানীয় ভক্তদের দানে মার্বেল বাঁধানো মন্দির হয়ে ওঠে। বঙ্গানুবাদে বেশ কয়েকটা পকেট হনুমান চালিসা বঙ্গালিবাবুর হাতেও তুলে দেন পূজারি। ‘‘যাকে খুশি দেবেন।’’

একই ছবি টালাপার্ক লাগোয়া রাজা মণীন্দ্র রোডেও। চক্কোত্তিদের পুরনো শীতলা মন্দিরের উল্টো দিকে বজরঙ্গবলী কবে বসেছেন, তা খেয়াল করেননি স্থানীয় বাসিন্দারাই অনেকে। গত মাসেই হনুমানজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ২৫০ কেজি চাল রান্নার আয়োজন ছিল! ভক্ত অভিষেক কোটাল, তপন দাসেরা অবশ্য বজরঙ্গবলী, শেতলা মায়ের ফারাক করতে রাজি নন। অভিষেক বললেন, ‘‘শনি-মঙ্গলে স্থানীয় বাঙালির ভিড়ই ভেঙে পড়ে মন্দিরে।’’

এ রাজ্যে রাম নবমীতে সশস্ত্র মিছিলের জবাবে কয়েক বছর আগে পাল্টা হনুমানজয়ন্তীর ডাক দিয়েছিল শাসক দল। ইএম বাইপাস ধরে পাটুলির মোড়ে পৌঁছে চোখে পড়ে পতপত করে উড়ছে ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা পতাকা। পাটুলি ঝিল লাগোয়া পঞ্চমুখী হনুমান মন্দিরের গায়েও বাংলায় হনুমান চালিসার উদ্ধৃতির খোদাই। মন্দির ঘেঁষা ফলক বলছে, গত বছর সৌন্দর্যায়নের কাজের উদ্বোধনে এসেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম (তখনও মেয়র হননি তিনি)। ভরদুপুরে চটি খুলে হনুমানজিকে প্রণাম ঠুকতে এসেছিলেন স্থানীয় যুবক রাজা দত্ত। বললেন, ‘‘বাবা লোকনাথ আর হনুমানজি— দু’জনকেই খুব মানি আমি।’’ জানা গেল, সদ্যসমাপ্ত ভোটের আগে যাদবপুরের বিজেপি প্রার্থী অনুপম হাজরাও এই মন্দিরেই পুজো দিয়েছিলেন।

কলেজ স্ট্রিটে বাঙালির গর্বের বইপাড়াতেও কিন্তু রামের বাহন স্বমহিমায় বিরাজমান। অর্ধশতকের পুরনো বই কারবারি স্বপন সাহার দোকানে নানা মাপের হনুমান চালিসার কাটতি। বাংলা অক্ষরে মূল শ্লোক থেকে পয়ার ছন্দে বঙ্গানুবাদ, সব মিলবে। স্বপনবাবুরও দাবি, ‘‘আমার ছোট দোকানেও বছরভর বজরঙ্গবলীর স্থায়ী প্রভাব। সত্যনারায়ণের পাঁচালি বা শ্রীকৃষ্ণ অষ্টোত্তর শত নামের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই হনুমান চালিসা বিকিয়ে থাকে।’’

বিশ্বকর্মাকে ছাপিয়ে গণেশপুজো, নেড়াপোড়া ভুলে হোলি-কা-দহন, কালীপুজোর বদলে দিওয়ালি উদ্‌যাপনের প্রবণতা ইদানীং ভালই চোখে পড়ছে। শীতলা-মনসাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে হনুমান পুজোও যুগধর্ম। ‘‘এটা এক ধরনের উত্তর ভারতীয় মানদণ্ডের শরিক হওয়ার লক্ষণ! হিন্দু ধর্মের বহু স্বর বর্তমানে চাপা পড়ে যাচ্ছে।’’— বলছেন ইতিহাসবিদ তথা প্রাক্তন আমলা জহর সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘আগেও সেন রাজাদের আমলে বাঙালি ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের পথ ধরেছে, আবার সুফিবাদ বা মঙ্গলকাব্যের লোকদেবতাদের কাছেও সরে এসেছে।’’ বাঙালির রসিকতার লব্জে ‘হনুমান’ বা ‘রাম’ এখনও পারস্পরিক পা টানাটানিরও অঙ্গ। ‘হনুমান কোথাকার’ ডাকে, আদরের বকুনিতেও চির অভ্যস্ত আমবাঙালি।

তবে বিপদে ‘হনুমান চালিসা’ পাঠেই বা বাঙালির মুশকিলটা কোথায়? তা নেই! কিন্তু রাম বা হনুমান রাজনীতির ‘অস্ত্র’ হওয়ার মধ্যেই বা কোথায় ধর্ম— প্রশ্ন সুদীপ্তবাবুর। শৈশবের ‘মনসা চাতাল’ হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারেননি তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ritual Hanuman Puja Hanuman Chalisa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE