Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

না-বলা কথার ডাকবাক্সে ইতিহাসের গল্প

গোরস্থানে সাবধান নয়। বরং গোরস্থানে স্বাগতম। ইতিহাসের পাতা থেকে গল্পের সুতো বাঁধা হোক বর্তমানে। যাতে এখনকার পর্যটন-ঠিকানা, শহরের প্রাচীনতম এই সমাধিক্ষেত্র হয়ে ওঠে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

চলছে চিঠির প্রদর্শনী। পার্ক স্ট্রিট সমাধিস্থলে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

চলছে চিঠির প্রদর্শনী। পার্ক স্ট্রিট সমাধিস্থলে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:০৪
Share: Save:

গোরস্থানে সাবধান নয়।

বরং গোরস্থানে স্বাগতম।

ইতিহাসের পাতা থেকে গল্পের সুতো বাঁধা হোক বর্তমানে। যাতে এখনকার পর্যটন-ঠিকানা, শহরের প্রাচীনতম এই সমাধিক্ষেত্র হয়ে ওঠে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এমনই প্রয়াসে এগিয়ে এসেছে এ শহরেরই স্কুলপড়ুয়ারা। শীত-শহরে প্রদর্শনী হয়ে সেজে উঠেছে পার্ক স্ট্রিটের পুরনো গোরস্থান।

ছোটখাটো কামিনী গাছটার কাছেই শুয়ে অভিমানী তরুণ। বিশ্ববিখ্যাত লেখক বাবার পুত্র। ছেলেরও লেখার হাত ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বাবা তাঁকে একেবারে নিভিয়ে দেন। ছেলের গৃহশিক্ষককেও সটান বলে দেন, না-লিখলেই ও সুখী হবে!

১৬ বছর বয়সে বিলেত থেকে এ দেশে এসে কোম্পানির ফৌজে যোগ দিয়েছিলেন সেই ভগ্ন মনোরথ তরুণ। চার্লস ডিকেন্সের চতুর্থ সন্তান ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স। সেটা সিপাহী বিদ্রোহের সময়। ছ’বছর বাদে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার হিসেবে কলকাতাতেই ফুরোয় সেই ছোট্ট জীবন। পার্ক স্ট্রিটের পুরনো গোরস্থানে ধূসর স্মৃতিফলকের নীচে চিরনিদ্রায় শায়িত ওয়াল্টার।

সেখানেই এখন একটা ডাকবাক্স রাখা। রয়েছে কিছু কাগজও। ডিকেন্স ও তাঁর ছেলের গল্পের সূত্র ধরে প্রিয়জনকে না-বলা কথার চিঠি লিখতে আগন্তুকদের আহ্বান জানাচ্ছে স্কুলপড়ুয়ারা। ডাকবাক্সে জমা হচ্ছে ঠিকানাহীন সব চিঠি।

ইয়ং বেঙ্গল-স্রষ্টা চিরতরুণ ডিরোজিওর সমাধির কাছে ডুমুরগাছটাতেও অজস্র লাল-নীল সুতো বাঁধা। তার ফাঁকে গোঁজা অজস্র ঠিকানাহীন চিঠি। একটিতে লেখা, ‘মা, এখানে আসার থেকে শুধুই তোমার কথা মনে পড়ছে। যদি এক বার

দেখতে পেতাম।’

উদ্যোগের নাম ‘আওয়ার হিস্ট্রি, দেয়ার টাইমস’! অতীতের সঙ্গে সমকালের সেতুবন্ধন। গোরস্থানের চেনা গা-ছমছমে ভুতুড়ে নির্জনতায় এই চিঠির মেলা দেখতেই হঠাৎ মেলা ভিড়ের অচেনা ছবি।

শিল্পসংগঠক রুচিরা দাসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, এই গোরস্থানের ইতিহাসবিদ কলেজশিক্ষক সুদীপ ভট্টাচার্য ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমিক নন্দী মজুমদার। গোরস্থানের ইতিহাস ও খোলা জায়গায় শিল্প প্রদর্শনের খুঁটিনাটি তাঁরাই শিখিয়েছেন কলকাতার দশটি

স্কুলের পড়ুয়াদের।

তাতেই উঠে এসেছে নানা দৃষ্টিভঙ্গি। সর্বধর্ম সমন্বয়পন্থী ব্রিটিশ সেনানী চার্লস স্টুয়ার্ট ওরফে ‘হিন্দু স্টুয়ার্টে’র কবরের কাছের আমের ডালে সাদা কাপড়ে যেমন ঝুলছে জসিমুদ্দিনের কবিতা— ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে’। জনৈক নামজাদা ব্রিটিশ নৌ কম্যান্ডারের সমাধি ঘিরে কাগজের নৌকোর বহর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রয়াত আঠেরো শতকের কলকাতার অভিজাত নারী এলিজাবেথ বারওয়েলের সমাধির কাছেও ছোট ছোট পোস্টার। তাতে সেকালের সাহেব-মেমদের আদবকায়দার কথা তুলে ধরেছে সুশীলা বিড়লা গার্লস স্কুলের মেয়েরা। ‘‘সে-যুগের জীবনের টুকরো টুকরো গল্প দারুণ উপভোগ করছে ছেলেমেয়েরা,’’ বলছিলেন পাঠভবন স্কুলের শিক্ষক গৌতম চৌধুরী।

এ ধরনের প্রয়াস জরুরি পদক্ষেপ বলে মনে করছেন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব। ব়ড়দিনের সময়টায় পার্ক স্ট্রিট ঘিরে নানা উৎসবে জোর দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে-কথা মনে করিয়ে মন্ত্রী বলছেন, ‘‘কলকাতার বেড়ানোর জায়গাগুলি ঘিরে উৎসব, প্রদর্শনী হওয়াটা ভাল। পর্যটকেরা এ সব উপভোগ করেন।’’ পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতেও, ঐতিহ্যকে বারবার নতুন ভাবে আবিষ্কার করাটা জরুরি।

গোরস্থানটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা ক্রিশ্চান বেরিয়াল বোর্ডের সম্পাদক অসীম বিশ্বাস বলছিলেন, গোরস্থানে শায়িত সাহেব-মেমদের উত্তরপুরুষরাও কখনও শিকড়ের টানে বিলেত থেকে এসে হাজির হন। এখন প্রদর্শনীর টানেও আসছেন অনেকেই।

অঘ্রাণ শেষের কলকাতায় মিলেমিশে যাচ্ছে ইতিহাসের গন্ধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Letters exhibition Cemetery Park Street
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE