বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীদের অনেকেই ছিলেন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার শিকার! খেপে উঠে গগ্যাঁর দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন ভ্যান গখ। নিজেই নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন। গত শতকে শিল্পী ফ্রান্সিস বেকন শরীরের মাংস খুবলে নেওয়া কষ্টের ছাপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন ক্যানভাসে। পাভলভের বাসিন্দাদের ছবিতে অবশ্য সেই অশান্তি নেই। কিন্তু ছবিগুলো দেখলে কে কোনটা এঁকেছেন, তা সহজেই বোঝা যাবে!
এই যে গোলগাল সুখী-সুখী মেয়ে-পুরুষ, তাতে স্পষ্ট হাসপাতালের পুরনো বাসিন্দা ‘ননীদা’-র স্বাক্ষর! ‘কে ওটা’? — স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকল্প আধিকারিক শুক্লা দাস বড়ুয়ার প্রশ্নের জবাবে ননীদা বোঝান, ‘‘আ-হা, মাথায় মুকুট দেখে বুঝতে পারছ না ওটা বৌ!’’ বর-বৌয়ের ছবি আঁকা সব থেকে পছন্দ ননীদার। ৩৫ থেকে ৬১ বছর বয়স পর্যন্ত, পরিবারহীন এই মানুষটির হাসপাতালই ঘর-বাড়ি। ফোকলা দাঁতের আড়ালে অস্পষ্ট শব্দে যিনি জীবনের আগামী পরিকল্পনা শোনান— ‘‘এখান থেকে বেরিয়ে পরের বছর একটা বিয়ে করতে হবে!’’
‘ননীদা’র ঈষৎ বিমূর্ত বর-বৌয়ের পাশে সীতার ছবি ঝকঝকে মসৃণ বাস্তব। তাঁর মেয়ে কলকাতার হস্টেলবাসী। মায়ের ছবির ‘স্বপ্নের বাড়ি’তে সে ডাইনিং টেবিলে খাচ্ছে কিংবা সাজানো সোফায় ঘুমিয়ে, নীচে পাহারাদার পোষা বেড়াল! একটা ছবিতে সীতা নিজেও রয়েছেন। পিঠে ডানা, পরীর মতো উড়ে যাচ্ছেন মা-মেয়ে। জনা ৪০ আবাসিক মিলে কেউ মাছ-প্রজাপতি এঁকেছেন, কেউ সিনেমায় দেখা গডজ়িলা। প্যাস্টেল বা কাঠকয়লার কাজই বেশি। হাসপাতালের বাইরের দেওয়াল থেকে আউটডোরের প্যানেল, ক্যান্টিনের পাশের বুড়ো বটগাছটা পর্যন্ত সেজে উঠছে ছবিতে ছবিতে।
কাজটির পরিচালক শিল্পী শ্রীকান্ত পালের চোখে, ছবি আঁকা এক ধরনের ওষুধও। ডিমের ক্রেট, খড়িমাটি, কাগজের মণ্ড, পুরনো পোশাক ধরে শিল্পের উপকরণ তৈরির মধ্যে অনেকের হাতের আলগা স্নায়ুর উপরে রাশ মজবুত হচ্ছে। ছবি আঁকায় বাড়ছে মনঃসংযোগও। চিকিৎসকদের মতে, এই রোগীদের অনেকেই সহমর্মিতা পেলে বাড়িতেও দিব্যি থাকতে পারতেন।
পাভলভের আবাসিকদের কাজের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কলকাতা আর্ট ফেস্টিভ্যালের তরফে লাইলি থম্পসন বলছেন, ‘‘সবাইকে কাছে না-টানলে কীসের শিল্প! ছবি দেখে অনেকেই হাসপাতালে বন্দি মানুষগুলোর মনের তল খুঁজে পাবেন।’’