Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কঙ্কাল বাড়িতে ঢুকতে এখন ভয় পান পার্থই

কয়েক মাস আগেও দিদি আর দুই কুকুরের কঙ্কাল নিয়ে একই ঘরে দিব্যি বাস করতেন তিনি। তাঁর চোখের সামনেই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে কঙ্কালে পরিণত হয়েছিলেন দিদি। সেই কঙ্কালের সামনে নিয়ম করে খাবার সাজিয়ে রাখতেন। ভয়ডর, দুর্গন্ধ কোনও কিছুই তাঁকে টলায়নি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫৯
Share: Save:

কয়েক মাস আগেও দিদি আর দুই কুকুরের কঙ্কাল নিয়ে একই ঘরে দিব্যি বাস করতেন তিনি। তাঁর চোখের সামনেই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে কঙ্কালে পরিণত হয়েছিলেন দিদি। সেই কঙ্কালের সামনে নিয়ম করে খাবার সাজিয়ে রাখতেন। ভয়ডর, দুর্গন্ধ কোনও কিছুই তাঁকে টলায়নি। নানা রকম মন্ত্র পড়া সিডি চালিয়ে রাখা থাকত ঘরের বিভিন্ন কোণে।

৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়িতে ফিরতে এখন আর পা সরছে না পার্থ দে-র। শুধু তা-ই কেন, ওই বাড়িতে ফেরার কথা ভাবলে রীতিমতো ‘ভয়’ই করছে তাঁর। আড়াই মাস আগে (১০ জুন) তাঁর বাবা অরবিন্দ দে-র দগ্ধ দেহ উদ্ধারের সূত্রেই ওই বাড়িতে প্রথম ঢোকে পুলিশ। তার পর সামনে আসে দিদি দেবযানী এবং দুই কুকুরের কঙ্কাল-রহস্য। সেই সময়কার পার্থ বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইতেন না। পৃথিবীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে চাইতেন না। তাঁকে বাইরে এনে পাভলভ হাসপাতালে পাঠাতে ভাল রকম বেগ পেতে হয়েছিল পুলিশকে। আড়াই মাস পাভলভে থেকে চিকিৎসার পরে সেই পার্থই এখন বলছেন, ‘‘ফাঁকা বাড়িটা আমাকে তো গিলে খেতে আসবে! ওখানে আমি আর থাকতে পারব না।’’

এতটাই পাল্টে গিয়েছেন দে-পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য পার্থ। পাভলভ হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মীদের তিনি বারবার বলছেন, ‘‘বাবা নেই, দিদি নেই, কুকুর দু’টো পর্যন্ত নেই। একা একা ওখানে গিয়ে থাকব কী করে!’’

এখানেই চিকিৎসার সুফল দেখতে পাচ্ছেন মনোবিদরা। স্বাভাবিক মানুষের মতোই পার্থ যে এখন ফাঁকা বাড়িতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন, একাকীত্ব বোধ করছেন— এটাই তাঁদের মতে পার্থর সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘চিকিৎসা যত এগিয়েছে, ততই ওঁর বাস্তববোধ ফিরে এসেছে। আগে উনি কী ছিলেন, এখন সেটা বুঝতে পারছেন।’’

রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পার্থকে যখন মানসিক হাসপাতালে আনা হয়, তখন তাঁর কথাবার্তা ছিল অনেকটাই অসংলগ্ন। ঠিক মতো দাঁত না মাজা, স্নান না করা, দিনের পর দিন একই পোশাক পরে থাকায় তাঁর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। অপরিচ্ছন্ন ভাবে থাকায় তার শরীরে চর্মরোগও দেখা দিয়েছিল। আড়াই মাস পরে আগের ছবিটা বিলকুল পাল্টে গিয়েছে। পাভলভের চিকিৎসকেরা বলছেন, নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ খাওয়ার কথা এখন আর তাঁকে মনে করিয়ে দিয়ে হয় না। রীতিমতো ধোপদুরস্ত পার্থর মুখে দিদির কথা শোনা যায় না বললেই চলে। চিকিৎসায় সেরে গিয়েছে চর্মরোগও। এখন নিয়ম করে ইংরাজি খবরের কাগজ চেয়ে খুঁটিয়ে পড়েন তিনি। গুনগুন করে তাঁকে গান গাইতেও শোনা যায়। ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ এখনও আছে। মাদার হাউসের প্রতি ভক্তিও বদলায়নি। কিন্তু যে পার্থ দরজা-জানলা বন্ধ করে রহস্যময় সিডি চালিয়ে বাড়িতে একটা আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি করছিলেন, যে ধর্মচর্চার তাগিদে তাঁর দিদি দেবযানী নাওয়াখাওয়া ত্যাগ করেছিলেন— পার্থর এখনকার ধর্মচিন্তা তার চেয়ে অনেকটা আলাদা। মাদার হাউসের প্রতিনিধিরা এলে তাঁদের কাছ থেকে ধর্মীয় বইপত্র চেয়ে নিয়ে আজকাল শান্ত ভাবে পড়াশোনা করেন পার্থ। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলেন, ‘‘টানা চিকিৎসাই অন্ধকার জীবন থেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে এনেছে ওঁকে।’’

পাভলভ হাসপাতালের ভিতরে সাধারণ মেল ওয়ার্ড থেকে কিছুটা দূরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের একটি গবেষণা-ঘরে আপাতত পার্থকে রাখা হয়েছে। ওই ঘরে তিনি ছাড়া আরও ছ’জন রোগী থাকেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁদের একজনকে আবার ‘কাকু’ বলে সম্বোধন করেন পার্থ। ওই ছ’জনের পরিবারের লোকেরা এলে তাঁদের সঙ্গেই গল্পে-আড্ডায় রীতিমতো জমে যান তিনি। কবে নিজে বাইরে বেরোতে পারবেন, সে নিয়েও আক্ষেপ করতে থাকেন বারবার। যে পার্থ আগে সব আত্মীয়-বন্ধু ত্যাগ করে নিজেকে কার্যত গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন, অন্য রোগীদের কাছে আসা আত্মীয়স্বজন দেখে এখন তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না! এমন একা-একাই কি কাটাতে হবে বাকি জীবনটা?’’ চিকিৎসকেরা মনে করছেন, একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে পার্থর এখন দরকার এক জন সঙ্গীর। যে কোনও স্বাভাবিক মানুষের কাছে যা বেঁচে থাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রসদ বলে মনে করেন মনোবিদরাও।

এক সময়ে বিদেশ থেকে চাকরি ছেড়ে আসা পার্থ চিকিৎসক ও কর্মীদের কাছে এখন বলেন, প্রতি মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছে স্রেফ শুয়ে-বসে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে ভাল কিছু করাটা জরুরি। সেটা কী? পার্থর জবাব, ‘‘সেবামূলক কিছু করতে চাই। পড়াশোনা করতে চাই। আর কুয়োর ব্যাঙ হয়ে না থেকে জগৎটাকে আরও ভাল ভাবে জানতে-বুঝতে চাই।’’ মনোবিদরা এই পরিবর্তন দেখে আরও নিশ্চিত হচ্ছেন যে, আরও আনেক আগে থেকেই পার্থর চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন ছিল। হলে হয়তো রবিনসন স্ট্রিটের বা়ড়ি কঙ্কালের বাড়িতে পরিণত হতো না। পার্থও জানিয়েছেন, এই দু’মাসের হাসপাতাল-বাস তাঁর জীবনের মূল দর্শনটাই বদলে দিয়েছে। এখন সুস্থ হয়ে তিনি ছুটি পাওয়ার জন্য ছটফট করছেন। ছুটির পর আপাতত মাদার হাউসেই নিয়ে যাওয়া হবে পার্থকে। পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ জানিয়েছেন, ‘‘মাদার হাউসের প্রতিনিধিরা এসে সইসাবুদ করে ওঁকে কোনও একটা হোম-এ নিয়ে যাবেন। সেখানেই আপাতত থাকবেন তিনি।’’

কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার পরে অবস্থার কি কোনও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে? চিকিৎসকেরা তা মনে করছেন না। মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রত্নাবলী রায়ও বলেন, ‘‘উনি শিক্ষিত মানুষ। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েও কী ভাবে থাকতে হবে তা নিশ্চয় বুঝবেন!’’ কী বলছেন পার্থ নিজে? তাঁর বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসাটা যে জরুরি, সেটা বুঝতে পেরেছি। আর কোনও ভুল হবে না। তবে সঙ্গীর অভাবটা বুঝতে পারছি।’’

আপাতত তাই মনের মতো এক জন সঙ্গী খুঁজছেন পার্থ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE