প্রশ্নটা সহজ। উত্তরটাও অজানা নয়। কিন্তু উত্তরদাতা যে এতটা চমকে দিয়ে চলে যাবেন, তা ভাবতে পারিনি।
বুধবার, সন্ধে পৌনে সাতটা। সল্টলেকের সিটি সেন্টার থেকে ফিরব বেহালায়। সঙ্গে আমার স্ত্রী। ওই শপিং মলের সামনেই আলো-আঁধারি রাজপথে হন্যে হয়ে ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি দু’জন। পরপর জনা তিনেক ট্যাক্সিচালক সটান না বলে চলে গিয়েছেন। বিরক্ত লাগছিল, রাগ হচ্ছিল। তবে, এ শহরের ট্যাক্সি সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত বলেই জানি, এখানে ট্যাক্সি ধরতে হলে আগে ধৈর্য ধরতে হবে। না হলে এই ধারাবাহিক ‘যাব না’র ঠেলা সামলাব কী করে! যদি কেউ ‘দয়া পরবশ’ হয়ে যেতে রাজিও হন, তবে তাঁকেও যে ওই দয়ার জন্য অতিরিক্ত ৩০-৪০ টাকা গুনে গুনে ‘নজরানা’ দিতে হবে, তা তো নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি।
আগে ট্যাক্সি ‘না’ বলে চলে গেলে হেরে যাওয়া গোলকিপারের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন পুলিশের নানা হেল্পলাইন হয়েছে। তাই ভাবলাম, ট্যাক্সির নম্বরগুলো টুকে নিই। পরে পুলিশকে জানাব। মোবাইলে পরপর তিনটি ট্যাক্সির নম্বর টুকেছি। তারা কেউ বেহালা যেতে রাজি নয়। আরও একটি ট্যাক্সি এল। এবং আরও এক বার সেই একই প্রশ্ন, ‘‘দাদা যাবেন, বেহালা?’’ ট্যাক্সিচালক মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বাঁ হাত তুলে না বলতে চাইলেন। আমি এগিয়ে গেলাম। ট্যাক্সির জানলার কাছে মুখ এনে বললাম, ‘‘নম্বরটা টুকে নিচ্ছি কিন্তু।’’ জানি, লাভ হবে না। তবু কিছুই কি বলব না? ট্যাক্সিটা দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমার কথা শুনে গতি কমালেন চালক। ঠান্ডা, নির্লিপ্ত, ভ্রূক্ষেপহীন চাহনি। বয়স আন্দাজ ৩৫-৪০। বললেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। টুকে নিন নম্বর।’’ আমার নম্বর টোকার জন্য বেশ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন ওই চালক। তার পরে গতি বাড়িয়ে চলে গেলেন। কাছাকাছি কোথাও পুলিশের কোনও উপস্থিতি চোখে পড়ল না।
অতীতে কোনও কোনও ট্যাক্সিওয়ালাকে নম্বর টোকার ভয়ে যেতে রাজি হতে দেখেছি। কিন্তু নম্বর টোকায় কোনও ট্যাক্সিচালককে ‘সহযোগিতা’ করতে এই প্রথম দেখলাম। দেওয়াল লিখনটা পড়ে ফেলতে অসুবিধা হল না। আমরা ট্যাক্সিচালকেরা নিজের মর্জির মালিক। যেখানে ইচ্ছে হবে যাব, যেখানে হবে না, যাব না। কেউ কিস্যু করতে পারবে না। এটাই চলে আসছে। এটাই চলবে।
হতাশায় মোবাইলটা এ বার বন্ধ করে দিলাম। নম্বর টুকে আত্মপ্রসাদের অতিরিক্ত যে কিছুই জুটবে না, তা তো স্পষ্টই হয়ে গেল। ট্যাক্সিচালকদের প্রত্যাখ্যানের অধিকার তো স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই কিছু দিন আগে ঘোষণা করে দিয়েছেন। সেখানে পুলিশের আর কী-ই বা করার আছে? আমার স্ত্রী ততক্ষণে নিজের ফোন থেকে ট্রাফিক পুলিশের হেল্পলাইন নম্বর ডায়াল করেছেন। ফোন বেজে যাচ্ছে। অন্তত সাত-আট বার চেষ্টা করেও সেই নম্বরে কাউকে পাওয়া গেল না। আমি ওঁকে ১০০ ডায়ালে ফোন করতে বললাম। এই নম্বরের ‘সুখ্যাতি’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি। তাই আশা বিশেষ ছিল না। কিন্তু কিছুটা অবাক করে দিয়েই ১০০ নম্বরে এক জন ফোন ধরলেন।
এ সব ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের কর্মী পরিচয় দিলে কিঞ্চিৎ সুবিধা মেলে হয়তো। কিন্তু ইচ্ছে করেই তা দিলাম না। দেখাই যাক না জল কত দূর গড়ায়। আমার স্ত্রী ফোনে বললেন, তিনি সিটি সেন্টারের সামনে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। একের পর এক ট্যাক্সি প্রত্যাখ্যান করে চলে যাচ্ছে। এ দিকে ট্রাফিক হেল্পলাইনের নম্বরেও কেউ ধরছেন না। ফোনের ওপার থেকে প্রশ্ন এল, ‘‘ম্যাডাম, আপনি ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন বলুন। আমরা গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’ এতটা সত্যিই আশা করিনি। তবে পুলিশের এই কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।
পুলিশের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে আরও তিন-চারটি ট্যাক্সি আমাদের ‘না’ বলে চলে গিয়েছে। আরও একটি এল। ‘‘দাদা, বেহালা যাবেন?’’ না শোনার জন্য তৈরিই ছিলাম। কিন্তু না, ইনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিজের হাতে আলতো চিমটি কাটলাম। ট্যাক্সিতে বসে ফের ১০০ ডায়ালে ফোন করলেন আমার স্ত্রী। পুলিশকে জানানো হল, অবশেষে ট্যাক্সি পাওয়া গিয়েছে। গাড়ি আর পাঠাতে হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy