Advertisement
E-Paper

প্রশাসন কড়া হবে কবে? ভাল বাসার স্বপ্ন পূরণে ঠকছেন মানুষই

শহর জুড়ে অবাধেই চলে অবৈধ নির্মাণ। পুলিশ বা পুরসভা সব জেনেও ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু কেন? উত্তরের খোঁজে আনন্দবাজার।

—প্রতীকী চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০৮
Share
Save

একটিই ফ্ল্যাট এক জনকে বিক্রি করার কথা বলা হয়েছে ১৮ লক্ষ টাকায়, আর এক জনকে ২২ লক্ষে। তৃতীয় জন আবার ওই ফ্ল্যাটটিই ২৫ লক্ষ টাকায় কিনতে চলেছেন জেনে মোটা অঙ্ক অগ্রিম দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাটটি এই তিন জনের কেউই পাননি। প্রোমোটার রেখে দিয়েছেন নিজের শ্যালিকার বিয়ের পরে তাঁকে উপহার দেবেন বলে!

যাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, মাসের পর মাস কেটে গেলেও তাঁরা সে টাকা ফেরত পাননি। অগ্রিম দিয়ে যাওয়া এক জনকে আবার বলে দেওয়া হয়েছে, ‘‘সময় হলে টাকা ফেরত পাবেন। আবার না-ও পেতে পারেন। ওই টাকার মায়া ছেড়ে দিন।’’ অভিযোগ, পুলিশে গিয়েও লাভ হয়নি। ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যাওয়ারও সুযোগ হয়নি ফ্ল্যাটটির কোনও বৈধ কাগজপত্র হাতে না থাকায়। তবে, কাগজপত্র হাতে থাকলেও বিশেষ সুবিধা হত বলে মনে করেন না অভিযোগকারীরা। সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারের নাকি এমনই দাপট!

বেআইনি নির্মাণ ঘিরে বার বারই সামনে আসে নানা ধরনের অভিযোগ। আর সমস্ত ক্ষেত্রেই ভুগতে হয় সেই সাধারণ মানুষকেই। রাজনীতির ময়দানেও এ নিয়ে জোর আলোচনা হয়। সমস্ত নির্বাচনের আগেই এ বিষয়ে চর্চা বাড়ে। এ বারও যার অন্যথা হয়নি। কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ নির্মাণ, বুঝতে না পেরে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে বুঝেও মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করতে জীবনের সঞ্চিত অর্থের সিংহভাগ দিয়ে দেন অনেকেই। তার পরে হয়তো জানা যায়, বিরাট ভুল করেছেন। সেই বাড়ি হয় ভেঙে পড়ে, নয়তো পুরসভা বেআইনি নির্মাণ বলে চিহ্নিত করার পরে ভেঙে দেওয়া হয়। প্রশ্ন ওঠে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে বুঝেও কেন প্রশাসন প্রথম থেকেই কড়া ব্যবস্থা নেয় না? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।

জানা গিয়েছে, বাম আমলে ‘ল্যান্ড লুজ়ার কোঅপারেটিভ সোসাইটি’ নামে একটি ছাতার তলায় অসংখ্য বেকার যুবক রাজারহাট-নিউ টাউন এলাকায় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করতেন। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে সেই কোঅপারেটিভ সোসাইটিরই জায়গা নেয় ‘সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে দাপট বাড়ে প্রোমোটারদের। টালির চালের ঘরওয়ালা যে জমিতে বহুতল ওঠার কথাই নয়, সেই জমির মালিককেই নগদ টাকা আর ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখানো হয়। এর পরে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেখানে ওঠে বহুতল। যে ঠিকানায় আগে হয়তো পাঁচ ঘর ভাড়াটে ছিল, সেখানেই এসে ঢোকে ১৪-১৫টি পরিবার। বাড়ির নকশা অনুমোদন হয় না, রেজিস্ট্রিও হয় না।

উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাসিন্দা নিমাই সাহার অভিযোগ, ‘‘এখানে ফ্ল্যাট কেনার পরে ১০ বছর কেটে গেলেও এখনও রেজিস্ট্রেশন করাতে পারিনি। প্রোমোটার পুরসভা থেকে কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (সিসি) তোলেননি। ফ্ল্যাটের বুকিংয়ের সময়ে অগ্রিম দিয়ে দেওয়ার পরে তা আমরা জানতে পারি।’’ হাজরার এক বাসিন্দার আবার অভিযোগ, ‘‘আমাদের আবাসনের নির্মাণকাজে একাধিক গলদ রয়েছে। কিন্তু ‘রিয়্যাল এস্টেট রেগুলেশন অথরিটি’ (রেরা)-তে যে অভিযোগ করে ক্ষতিপূরণ চাইব, সেই সুযোগ নেই। আমাদের প্রোমোটার সেখানে আবাসন প্রকল্পটি নথিভুক্তই করাননি।’’ নিয়ম মতো, তিন কাঠা জমিতে ছ’টির বেশি ফ্ল্যাট তৈরি করলেই সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারকে ‘রেরা’-তে প্রকল্পটি নথিভুক্ত করাতে হয়। নথিভুক্ত করানো মানে সেই আবাসনে কোনও গলদ থাকলে ক্রেতা রেরা-তে অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের খরচের ১০ শতাংশ পর্যন্ত সর্বাধিক ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হতে পারে। কিন্তু অভিযোগ, বেশির ভাগ ছোট, মাঝারি প্রোমোটার ‘রেরা’-তে প্রকল্পের নথিভুক্তি করান না। লোকবলের অভাবে প্রকল্পের নথিভুক্তি না করানোর অপরাধে প্রোমোটারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে পারে না রেরা-ও।

বিধাননগর, দমদমের মতো এলাকায় আবার সরকারি নিয়ম শিথিল হওয়ার সুযোগ নিয়েই বেআইনি কারবারের রমরমা চলছে বলে অভিযোগ। বিধাননগরের এক পুরকর্তাই জানাচ্ছেন, ২০২৩ সালের আগে পর্যন্ত মিউটেশনের জন্য কমপ্লিশন সার্টিফিকেট বা সিসি বাধ্যতামূলক ছিল বিধাননগরে। সাধারণত, যে কোনও নির্মাণকাজের আগে সেটির নকশা অনুমোদন করাতে হয় পুরসভা থেকে। নির্মাণকাজ শেষ হলে সিসি নেওয়ার আগে একটি সংশোধিত নকশা তৈরি করে পুরসভায় জমা দিতে হয়। ওই সংশোধিত নকশায় ধরা পড়ে, কতটা অংশ বাড়তি নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে সব ঠিক থাকলে সিসি পাওয়া যায়। ওই পুরকর্তার কথায়, ‘‘কিন্তু নিয়ম শিথিল হওয়ায় আর সিসি কেন, অনুমোদিত নকশারও প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে, প্রোমোটার সিসি নেওয়ার আগেই আবাসন কমিটির হাতে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করে চলে যাচ্ছেন।’’ জানা যাচ্ছে, বিধাননগরে এখন নির্মাণকাজ করার জন্য পুরসভা এক ধরনের ছাড়পত্র দিচ্ছে প্রোমোটারদের। সচেতন হয়ে ক্রেতাদেরই দেখে নিতে বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারের ছাড়পত্র আছে কি না। দমদমের এক বাসিন্দার প্রশ্ন, ‘‘সব দেখেশুনে এগোনোর পরেও অনিয়মের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, ভাল বসবাসের স্বপ্ন যেন ঝলসানো রুটি।’’ (চলবে)

তথ্য সংগ্রহ: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, নীলোৎপল বিশ্বাস, কাজল গুপ্ত, চন্দন বিশ্বাস, মেহবুব কাদের চৌধুরী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Constructions Administration negligence Safety Negligence

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}