Advertisement
E-Paper

পরীক্ষা পরে, আগে তো উৎসব হোক!

এ বছর সরস্বতী পুজো শেষ হচ্ছে আজ, সোমবার। কাল, মঙ্গলবার শুরু মাধ্যমিক। তার ১৪ দিনের মাথায় উচ্চ মাধ্যমিক। পরীক্ষার মরসুমে যাতে মাইক না বাজে, তা নিয়ে বারবার সতর্ক করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু পাড়ায় পাড়ায় এ ভাবেই গত এক মাস ধরে মাইকের দৌরাত্ম্য চলছে বলে অভিযোগ।

নীলোৎপল বিশ্বাস ও সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০৬
শব্দদানব: আমহার্স্ট স্ট্রিটের জলসায় ডিজে বক্স। শনিবার রাতে। নিজস্ব চিত্র।

শব্দদানব: আমহার্স্ট স্ট্রিটের জলসায় ডিজে বক্স। শনিবার রাতে। নিজস্ব চিত্র।

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কেমন, জানতে ছাত্রের বাড়ি গিয়েছিলেন গৃহশিক্ষক। হঠাৎ ছাত্রের বাড়ির গায়ে লাগানো মাইকের চোঙ বেজে উঠল তারস্বরে। ঘোষণা শুরু হল, আজ কোন কোন নেতা-মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঠিক কী কী অনুষ্ঠান রয়েছে। প্রবল বিরক্ত ছাত্র বললেন, ‘‘এই শুরু হল স্যার। এ বার ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমার মাইকগুলোর মতো সারা দিন বাজবে। রাতে হবে নাচ-গান। এর মধ্যে পড়া যায়?’’

এ বছর সরস্বতী পুজো শেষ হচ্ছে আজ, সোমবার। কাল, মঙ্গলবার শুরু মাধ্যমিক। তার ১৪ দিনের মাথায় উচ্চ মাধ্যমিক। পরীক্ষার মরসুমে যাতে মাইক না বাজে, তা নিয়ে বারবার সতর্ক করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু পাড়ায় পাড়ায় এ ভাবেই গত এক মাস ধরে মাইকের দৌরাত্ম্য চলছে বলে অভিযোগ। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী অভিযোগ করছেন, শনি-রবি হলে তো কথাই নেই, গোটা শীতকাল জুড়েই নানা অনুষ্ঠান লেগে ছিল এলাকা জুড়ে। ছুটির দিনে শাসক দলের মাইকের জোরের সঙ্গে পাল্লা দিতে সোম থেকে শুক্রবারের মধ্যে কাজের দিনগুলি বেছে নিয়েছিলেন বিরোধীরা। মানা হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্ট এবং কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে জাতীয় স্তরে তৈরি হওয়া শব্দবিধিও। ওই বিধি অনুযায়ী, যে কোনও বোর্ডের পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে থেকে পরীক্ষা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ্য স্থানে মাইক এবং সাউন্ড বক্সের ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরীক্ষার মাত্র দু’দিন আগেও সেই নির্দেশিকাকে অমান্য করে মাইক বাজাতে দেখা যাচ্ছে বলে দাবি ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘এ ভাবে মাইক বাজানো বরদাস্ত করা যায় না। আমাদের ১০ জনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল রাস্তায় ঘুরছে। তাঁদের চোখে পড়লে তাঁরাই পুলিশকে জানাবেন। পুলিশও তৎপর হতে পারে।’’ যদিও পুলিশের এই তৎপরতা চোখে পড়েনি বলেই অভিযোগ করলেন কলকাতা পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অমল চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘কী আর

বলব? আমার দলের লোকজনই এলাকায় তারস্বরে মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করছেন। নিজে পুলিশকে এসএমএস পাঠিয়ে অভিযোগ জানিয়েছি। কোনও লাভ হয়নি।’’

বেপরোয়া মাইক বাজানো বন্ধ করতে জনপ্রতিনিধিরই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে সাধারণ মানুষের ঝক্কি কোন পর্যায়ে? স্থানীয়দের অভিযোগ, বেলেঘাটার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে বিদেশি পাখি এবং সামুদ্রিক মাছের প্রদর্শনী। রবিবারও তা চলছে। এ জন্য ওই এলাকায় ১০০টি চোঙ লাগানো হয়েছে। এক পরীক্ষার্থীর আত্মীয়ের কথায়, ‘‘পুলিশকে বারবার ফোন করলাম, তিন দিনেও মাইক বন্ধ হল না।’’ উত্তর কলকাতা যুব তৃণমূলের সভাপতি জীবন সাহা অবশ্য বললেন, ‘‘এই শীতকালেই তো একটু উৎসব হয়!’’

আমহার্স্ট স্ট্রিট-মহাত্মা গাঁধী রোডের মোড়ে রজত জয়ন্তী বর্ষের সরস্বতী পুজোমণ্ডপের উল্টো দিকে মঞ্চ বাঁধাই ছিল। শনিবার রাতে সেখানেই বসে জলসার আসর। আমহার্স্ট স্ট্রিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবরুদ্ধ করে সেই আসরে আলো ও ডিজে-র যুগলবন্দিতে কার্যত কান পাতা দায়। পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতির কী হবে, থোড়াই কেয়ার! বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, ওই পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর সোমা চৌধুরী। প্রকাশ্যে রাস্তায় যখন নিয়ম-কানুনের পরোয়া না করে অনুষ্ঠান চলছে, তখন তিনি অনুষ্ঠানস্থলেই উপস্থিত ছিলেন বলে অভিভাবকদের একাংশের দাবি। এক অভিভাবক জানান, তৃণমূল কাউন্সিলর অনুষ্ঠানস্থলে হাজির। তাঁর স্বামী তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা প্রিয়াল চৌধুরী মঞ্চে উঠে কলকাতার শিল্পীর হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি তুলে দিচ্ছেন। সেই আবহে নির্দেশিকার খবর কে রাখে? সোমা বলেন, ‘‘মুম্বইয়ের শিল্পীর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যায়নি। সে জন্য অনুষ্ঠান শুরুর আগে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া হয়। মঞ্চ ছাড়া আর কোথাও মাইক বাজানো হয়নি। রবিবারের অনুষ্ঠানও বাতিল করেছি আমরা। এর পরেও ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগ করছেন বিরোধীরা।’’

কলকাতা পুরসভার মতো একই ছবি দক্ষিণ দমদমের কালিন্দীর মাঠে। সেখানে গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল পুরসভার ক্রীড়া দফতর। প্রদর্শনী ও ফাইনাল ম্যাচ উপলক্ষে মঞ্চে মাঠে হাজির ছিলেন পুরপ্রধান, চেয়ারম্যান-পারিষদ প্রদীপ মজুমদার, প্রবীর পাল-সহ অন্য জনপ্রতিনিধিরা। কয়েক জন পরীক্ষার্থীর অভিযোগ, ‘‘যশোর রোড থেকে মাঠ পর্যন্ত বাতিস্তম্ভে চোঙ টাঙানো হয়েছিল। মাধ্যমিকের দিন তো হঠাৎ করে ঠিক হয়নি। এ সময়ে পুরসভাই বা প্রতিযোগিতার আয়োজন করল কেন?’’ ক্রীড়া দফতরের চেয়ারম্যান-পারিষদ প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘মাঠের মধ্যে বক্স বাজানো ছাড়া রাস্তায় কোনও মাইক বাজেনি। এই টুর্নামেন্ট অনেক আগে থেকে ঠিক হয়েছিল।’’ লেক টাউন বি ব্লক পার্কে আবার পাঠ্যপুস্তক প্রদান কর্মসূচিতেও মাইক বেজেছে বলে অভিযোগ। পাখি মেলা, আনন্দমেলা, পরিবেশ মেলা, শিশু উৎসবের ভারে দমদমের রাস্তায় বছরভর মাইকের দাপট নতুন কিছু নয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোনও অনুষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও নাগেরবাজার মোড়ে তোরণের উপরে বাঁধা রয়েছে মাইক। দমদম রোডের একাধিক বাতিস্তম্ভেও সেই দৃশ্য। শিয়রে পরীক্ষা হলেও সেই সংস্কৃতি থেকে নিস্তার নেই।

গোটা বিষয়টি নিয়ে দায় এড়াচ্ছেন পুলিশ আধিকারিকেরা। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (১) জাভেদ শামিমকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘শিলংয়ে ব্যস্ত আছি। থানা স্তরে পুলিশি নজরদারি নিশ্চয় রয়েছে।’’ বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘নজরদারি চলছে। অভিযোগ পেলেই পদক্ষেপ করা হবে।’’

সেই নজরদারিকে অবশ্য একেবারেই নম্বর দিচ্ছেন না পরীক্ষার্থীরা।

Saraswati Puja Sound Box Madhyamik Higher Secondary Exam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy